নিবন্ধন না থাকায় ব্যাটারি রিকশা ছিনতাই বাড়ছে

বাধা দিলেই ঘটছে খুনের মতো ঘটনা, খুন হচ্ছেন চালকরা, নিবন্ধনের আওতায় এলে অপরাধ কমবে

প্রকাশ | ২৭ মে ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের মতো যানবাহন নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এসব যানবাহনের কোনো নিবন্ধন নেই। যে কারণে সারাদেশে এ ধরনের কি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নাই। নিবন্ধন না থাকায় হরহামেশাই এসব যানবাহন ছিনতাই হচ্ছে। ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই চালকদের হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে। নিবন্ধন না থাকায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হলে এসব যানবাহনকেন্দ্রিক অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০২০ সালের ১০ মার্চ ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল বা বৈদু্যতিক যানবাহন সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। তৎকালীন বিআরটিএ-এর চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনটি পরবর্তীতে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়, পেট্রোল বা অকটেন বা অন্য জ্বালানির মতো রিচার্জেবেল (বার বার চার্জ দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন) ব্যাটারিচালিত চার চাকা ও তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এ ধরনের যানবাহনকে নিবন্ধনের বিষয়েও সুপারিশ করা হয়। তবে বাইসাইকেল ও রিকশায় কোনো রিচার্জেবেল ব্যাটারি বসানো হলে, তা চালানো যাবে না। সবশেষ ২০২২ সালের ১৫ জুন বিদু্যত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে একটি আদেশ জারি করা হয়। মন্ত্রণালয়টির তৎকালীন সচিব মো. হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, ব্যাটারিচালিত বা রিচার্জেবেল যানবাহন অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব। তাই এ ধরনের যানবাহন ব্যবহারে মানুষ যাতে উৎসাহিত হয়, এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এমনকি পরিবেশবান্ধব এসব যানবাহন সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। এসব যানবাহন যাতে রাস্তায় অনায়াসে চলতে পারে, এজন্য রাস্তার পাশে সিএনজি, অকটেন, পেট্রোল বা ডিজেল পাম্পের মতো চার্জিং স্টেশন স্থাপন করার প্রস্তাবও করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞাত কারণে অদ্যাবধি সেই আদেশ বা উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। এমনকি সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক চলতে দেওয়া হয় না। কারণ হিসাবে সড়ক-মহাসড়কের নানা দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে বলা হয়, এসব যানবাহন সরকারের তরফ থেকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। যানবাহনগুলোর অনিবন্ধিত। অর্থাৎ অবৈধ। ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে এসব যানবাহন চলতে দেওয়া হয় না। তবে অবৈধভাবে এসব যানবাহন ঢাকার আশপাশের প্রতিটি অলিগলিসহ পুরো দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সারাদেশে এ ধরনের যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা ধারণারও বাইরে। পুরো দেশ সয়লাব হয়ে গেছে এসব যানবাহনে। এসব যানবাহনের দাপটে বিলুপ্তির পথে প্যাডেল রিকশা। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক প্যাডেল রিকশার চেয়ে দ্রম্নত গতিতে চলে। ব্যস্ত মানুষ সময় বাঁচাতে ব্যাটারিচালিত যানবাহনে চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত ছেয়ে গেছে এসব যানবাহনে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব যানবাহন অনিবন্ধিত। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। অপরাধীরা হরহামেশাই এসব যানবাহনকেই টার্গেট করছে। তারা যাত্রীবেশে এসব যানবাহনে ওঠে চালককে জিম্মি করে বা অজ্ঞান করে বা হত্যা করে ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে এসব যানবাহন। এসব যানবাহন ছিনতাই করতে সারাদেশে গড়ে উঠেছে বহু ছিনতাইকারী কাম কিলার গ্রম্নপ। ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই তারা চালককে হত্যা করে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর গোপন কোনো গ্যারেজে রেখে দেয়। সেখানে গাড়ির রং পরিবর্তন করে বা কাঠামোগত পরিবর্তন করে অন্য জেলায় বিক্রি করে দিচ্ছে। সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক ছিনতাই ও ছিনতাইয়ে বাধা দেয়ার সূত্রধরে গত ২ বছরে শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে এ ধরনের যানবাহন ছিনতাই ও চালকদের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অহরহ গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। এসব যানবাহনের কোন নিবন্ধন না থাকায় ছিনতাই করতে সুবিধা হয়। সহজেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তারা এসব যানবাহনকে টার্গেট করে। প্রথমে তারা খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে চালককে খাইয়ে অজ্ঞান করে বাহনটি চুরি করার চেষ্টা করে। তাতে সুবিধা না হলে নির্জন জায়গা থেকে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। তাতে বাধা দিলেই তারা চালককে হত্যা করে গাড়িটি ছিনিয়ে নিত। চোরাই বা ছিনিয়ে নেয়া গাড়ির ক্রেতাদের সিন্ডিকেট আছে। তারা চোরাই গাড়ি কিনে তা রং বা কাঠামোগত পরিবর্তন করে অন্য জেলায় বিক্রি করে দিত। চোরাই গাড়ির অধিকাংশই বিক্রি করা হতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ডিআইজি হারুন আরও বলেন, এসব যানবাহনকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) কাজ করতে পারে। অন্যান্য যানবাহনের মত এসব যানবাহন স্বীকৃতি পেলে এসব যানবাহনকে কেন্দ্র করে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তা তুলনামূলকভাবে অনেকাংশে কমে যাবে। র্ যাব সূত্রে জানা গেছে, ধারাবাহিক অভিযানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইকারী কাম খুনি চক্রের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়াদের তথ্য মতে, তাদের মূল টার্গেট ইজিবাইক। সারাদেশেই ইজিবাইক ছিনতাইকারী চক্র আছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ কেন্দ্রিক ইজিবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ জন গ্রেপ্তারের পর জানায়, তারা কেরানীগঞ্জ থেকে গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের জাকিরের গ্যারেজে বিক্রি করে দিত। পরে জাকিরকে চোরাই ৬টি ইজিবাইকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ইজিবাইক ছিনতাই রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই এসব যানবাহন ছিনতাইয়ের মতো হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। সকল তদন্তকারী সংস্থার কাছে ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত ভ্যান ও ব্যাটারিচালিক রিকশা ছিনতাইয়ের সূত্রধরে ঘটা হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত বহু মামলার তদন্ত চলছে। প্রতিদিনই এ ধরনের হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। পুলিশের তরফ থেকে বিষয়টির আদ্যোপান্ত উলেস্নখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ ফাইল পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এসব যানবাহনে ব্যবহৃত ইঞ্জিনের কোনো চেসিস নম্বর নেই। যেগুলোর আছে, সেগুলো ছাপ দেওয়া। অর্থাৎ নকল। সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দেশীয় প্রস্তুুতকারকরা ইচ্ছামতো এসব যানবাহন তৈরি করে বিক্রি করছে। অধিকাংশ ইজিবাইক চালকেরই গাড়ি চালানোর কোনো লাইসেন্স নেই। ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা ইসু্যতে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের কথা রয়েছে। বৈঠকে এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক সংক্রান্ত সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, এসব যানবাহনের কারণে হরহামেশাই খুনের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বহু মামলার তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনও এসব যানবাহনের চালক হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত অনেক মামলার তদন্ত করছে পিবিআই। সার্বিক পর্যালোচনায় ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশাকে বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যে আনা জরুরি। অন্যথায় এ ধরনের অপরাধ আরও বাড়তে পারে। যানবাহন হিসেবে নিবন্ধিত হলে এসব যানবাহন সংক্রান্ত অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (পুরকৌশল) বিভাগের শিক্ষক, সড়ক ও দুর্ঘটনা বিষয়ক দেশের খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ এ ধরনের যানবাহনকে অবশ্যই একটি নীতিমালার মধ্যে আনা জরুরি। নতুবা সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত এসব যানবাহন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। স্বাভাবিকভাবেই এসব যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে আশঙ্কাজনকহারে। কারণ এসব যানবাহনের দাম তুলনামূলক অনেক সস্তা বা হাতের নাগালে। তাই এখনই উচিত বিআরটিএ-কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকে এর সুরাহা করা। এ ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলে স্বাভাবিক কারণেই সড়কে দুর্ঘটনা ও অপরাধ কমবে। প্রসঙ্গত, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারির পর গত ১৯ ও ২০ মে টানা দুই দিন ঢাকার মিরপুর, পলস্নবী, কালশী, মিরপুর-১১, রামপুরা, ডেমরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ, দুটি পুলিশ বক্স ভাংচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়, অন্তত ১০টি যানবাহন ভাংচুর, পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত পুলিশ, পথচারী ও বিক্ষোভকারীসহ অন্তত ১৫ জনের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে ঢাকার নির্ধারিত সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার অনুমতি দেন। ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক ও মালিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ এবং ভাংচুরের ঘটনায় মিরপুর ও কাফরুল থানায় ১টি করে ২টি এবং পলস্নবী থানায় ২টি মোট ৪টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ৪২ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। আজ ২৩ মে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট আদালতে ৪২ জনের জামিন শুনানির দিন ধার্য আছে।