টাঙ্গাইলের ১৬ সরকারি অফিসে ওড়ে না জাতীয় পতাকা!

অধিকাংশ সরকারি অফিসপ্রধানরা মনে করেন, শুধু বিশেষ দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বাধ্যতামূলক। সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে বাধ্যবাধকতা নেই

প্রকাশ | ১৫ মে ২০২৪, ০০:০০

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
সরকারি ভবনের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে স্টিল বা লৌহদন্ড, টাঙানো হয়নি জাতীয় পতাকা। সরকারি অফিসের ভেতরে দিব্যি সব দৈনন্দিন কাজ চলছে। কর্তা-ব্যক্তিরাও বিভিন্ন দরকারি ফাইলে স্বাক্ষর করছেন- আলোচনা করছেন নানা বিষয়ে। কিন্তু দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়নি, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। এ চিত্র টাঙ্গাইলের ১৬টি সরকারি অফিসের। গত এক মাসে একদল গণমাধ্যমকর্মীর পর্যবেক্ষণে বিষয়টি ওঠে আসে। জানা যায়, বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২ (সংশোধিত ২০২৩) এর ৬ ধারার উপ-ধারা (১) অনুযায়ী সরকারি ভবনসমূহে সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা রয়েছে। একই বিধিমালার ৭ ধারায় পতাকার সম্মান বজায় রাখতে ২৬টি উপ-ধারার মাধ্যমে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই বিধিমালার ৮ ধারায় ৫টি উপ-ধারার মাধ্যমে সাধারণ নির্দেশাবলি দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত বিধিমালার ৬ এর উপ-ধারা (১) এ বলা হয়েছে- 'গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন এবং অফিসসমূহ, যেমন- রাষ্ট্রপতির বাসভবন, সংসদ ভবন প্রভৃতি, সব মন্ত্রণালয় এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সচিবালয় ভবনসমূহ, হাইকোর্টের অফিসসমূহ, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসমূহ, বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার/কালেক্টর, চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের অফিসসমূহ, কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগারসমূহ, পুলিশ স্টেশন, (শুল্ক পোস্টসমূহ, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এইরূপ অন্যান্য ভবন) এবং সরকার কর্তৃক সময় সময় নির্ধারিত ভবনসমূহে সব কর্মদিবসে 'বাংলাদেশের পতাকা' উত্তোলন করা হইবে।' সরেজমিনে দীর্ঘ এক মাসের পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল (সোমবার) থেকে ১৪ মে (মঙ্গলবার) পর্যন্ত জেলা সদরের ১৬টি সরকারি কার্যালয়ে নির্দিষ্ট স্থান ও পতাকা উত্তোলনের লোহার দন্ড থাকলেও কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে না। সরকারি অফিস ও ভবনগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইলের সড়ক ভবন (সওজ), গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামার বাড়ি), জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিশু একাডেমি, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, টাঙ্গাইল বিটিসিএল, আবহাওয়া অফিস, প্রাণিসম্পদ কার্যালয়, জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করার বিষয়ে টাঙ্গাইলের অধিকাংশ সরকারি অফিসপ্রধানরা মনে করেন, শুধু বিশেষ দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বাধ্যতামূলক। সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে বাধ্যবাধকতা নেই। সব অফিসেই একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বা নিরাপত্তা প্রহরীকে পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া থাকে। 'পতাকা উত্তোলনের বিধিমালা'য় স্পষ্ট করে সব কর্মদিবসে পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা নেই। বিধিমালায় '.....সরকার কর্তৃক সময় সময় নির্ধারিত ভবনসমূহে সব কর্মদিবসে 'বাংলাদেশের পতাকা' উত্তোলন করা হইবে' বলা হয়েছে। ওখানে '....সরকার কর্তৃক সময় সময়....' বলা হয়েছে, নির্দেশনার বাইরে সব কর্মদিবস বলা হয়নি- এটাকেই অনেকে কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চমান সহকারী (ইউডিএ) আবু বকর সিদ্দিক জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না। তারা সাধারণত বিশেষ দিবসগুলোতে যথানিয়মে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, বিষয়টি অতীব জরুরি- জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করার কোনো সুযোগ নেই। তার অজান্তে এটা হয়েছে- তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্টদের জাতীয় পতাকা প্রতিদিন উত্তোলনের নির্দেশ দেন। টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম তৌহিদুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে উপ-সহকারী প্রকৌশলী বাবু কুমার বিশ্বাস বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা নেন। টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ (সড়ক ভবন) অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া আজমিরী খান জানান, তিনি টাঙ্গাইলে নতুন যোগদান করেছেন। দেশের জাতীয় পতাকা প্রতিটি মানুষের গর্ব ও অহঙ্কার। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ডেকে বিষয়টি জানতে চান এবং নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেন। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানান, তারা ভাড়া ভবনে অফিস পরিচালনা করছেন। তারপরও তারা বিশেষ দিবসে নিয়মিত যথানিয়মে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। প্রতি কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবগত নন- বিধিমালা দেখে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। একই ভবনে অবস্থিত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিচালক মহর আলী মোলস্না অনুপস্থিত থাকায় তার কার্যালয়ের কেউ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। টাঙ্গাইল জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুল লতিফ মোলস্না জানান, তিনি টাঙ্গাইলে নতুন যোগদান করেছেন। তাছাড়া ভাড়া ভবনে অফিস থাকায় তারা বিশেষ দিবস ছাড়া পতাকা উত্তোলন করতে পারে না। বিশেষ দিবসে বিশেষ ব্যবস্থায় তারা জাতীয় পতাকা যথাযথ মর্যাদায় উত্তোলন করে থাকেন। তিনি জানান, পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের স্থায়ী ভবনের জন্য প্রাক্কলন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া আছে। নিজস্ব ভবন নির্মাণ হলে তারা নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। টাঙ্গাইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন জানান, বিষয়টি তার নজরে ছিল না। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিলে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তড়িঘড়ি পতাকা উত্তোলন করেন। টাঙ্গাইল জেলা রেজিস্ট্রার মো. মাহফুজুর রহমান খান জানান, তার পদোন্নতি হয়েছে- দ্রম্নতই তিনি হেড অফিসে যোগদান করবেন। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়টি জরাজীর্ণ থাকায় তিনি কিছুটা উন্নয়ন করতে গিয়ে দেখতে পান পতাকা উত্তোলনের স্থান নেই। বাধ্য হয়ে কার্যালয়ের সামনে সড়ক ঘেঁষে স্ট্যান্ড স্থাপনের জায়গা তৈরি করেছেন। জনসমাগমের ভিরে সেখানে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। তারপরও বিশেষ দিবসে বিশেষ ব্যবস্থায় জাতীয় পতাকা যথাযোগ্য মর্যাদায় উত্তোলন করা হয়। তিনি দাবি করেন, জমিদারি আমলের জরাজীর্ণ কার্যালয়টি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হলে জনগণের সেবা পাওয়া সহজতর হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। টাঙ্গাইল শিশু একাডেমির জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা খন্দকার নিপুন হোসাইন জানান, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়মিত যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নামানো হয়। সেজন্য তাদের ওখানে নিয়মিত উত্তোলন করা হয় না। তবে বিশেষ দিবসে নিয়মিত উত্তোলন করা হয়। টাঙ্গাইল আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এস আকবর খান জানান, জাতীয় পতাকা ব্যবহারের একটি আইন আছে। সেখানে পতাকা অবমাননার শাস্তির বিধানও আছে। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করা দরকার। বিধি মোতাবেক পতাকা উত্তোলন না করা জাতীয় পতাকা অবমাননার শামিল। জাতীয় পতাকা অবমাননায় সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। তিনি জানান, আসলে জাতীয় পতাকার সঙ্গে দেশপ্রেমের বিষয়টি জড়িত। তাই সব সরকারি ভবনে যথাযথ মর্যাদায় জাতীয় পতাকার ঠিকমতো ব্যবহার করা উচিত। যারা বা যে অফিসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না- তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম বলেন, দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতীয় পতাকা পেয়েছি। তাই আমাদের জাতীয় পতাকা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ পতাকা বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণকে একত্রিত করেছিল। এ পতাকাতলে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতাকে স্বাধীন করার জন্য শপথ নিয়েছিল। বীর শহিদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকার লাল বৃত্ত সব দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র রক্তের প্রতীক। তিনি জানান, সরকারি অফিস-আদালতে সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নিয়ম রয়েছে। যেসব অফিস বা ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না তিনি বা তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত। তাদের কাছ থেকে জনসাধারণও সেবা পায় না। তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জাতীয় পতাকা যথাযথ মর্যাদায় উত্তোলনের বিষয়ে একধিকবার কথা বলেছেন। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যজিস্ট্রেট মো. কায়ছারুল ইসলাম বলেন, সরকারি ভবনে সব কর্ম দিবসে জাতীয় পতাকা যথাযোগ্য মর্যাদায় উত্তোলন এবং যথাসময়ে নামানোর নিয়ম রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও যথা সময়ে নামানো হয়। তিনি জেলা পর্যায়ের সব অফিস বা ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা দেবেন এবং যথাযথভাবে তদারকি করবেন।