শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১
আইইইএফএ'র গবেষণা তথ্য

শিল্পে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ালে এলএনজি ব্যয় কমবে

বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন ডলার
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শিল্পে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ালে এলএনজি ব্যয় কমবে

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আরও আমদানির পরিবর্তে জ্বালানি দক্ষতার উন্নতি করলে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। সোমবার প্রকাশিত দ্য ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সংস্থাটি দেশের প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতার ৫১টি শিল্পের ১২৪টি গ্যাস চালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর জরিপ করে এই গবেষণা প্রতিবেদন করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যেসব শিল্প কারখানা ক্যাপটিক জেনারেটরের মাধ্যমে বিদু্যৎ উৎপাদন করে, তারা পুরনো জেনারেটর বদলে নতুন উচ্চ দক্ষতার জেনারেটর ব্যবহার করলে এবং উৎপাদিত তাপবর্জ্য যথাযথভাবে কাজে লাগালে এলএনজির চাহিদা কমে আসবে। এতে দেশে বছরে এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় কমতে পারে প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন ডলার।

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল থাকায় এলএনজি কিনে বিদু্যৎ উৎপাদন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ করেছিল তা বর্তমান বাস্তবতায় ব্যাক ফয়ার করতে পারে। তাই বাংলাদেশের উচিত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানো। এতে আমদানি ব্যয় কমার পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি কমে আসবে বলেও প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক শফিকুল আলম বলেন, 'গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় অস্থিতিশীল জ্বালানি এলএনজির ওপর নিভর্রশীলতা মাত্রাতিরিক্ত বাড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও ঝুঁকিতে পড়বে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যখন সাশ্রয়ী দামে এলএনজি আমদানি শুরু করে তখন তা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ঠিক এক বছরের মাথায় এলো কোভিড-১৯ এবং সেই সঙ্গে এলএনজির সরবরাহ-শৃঙ্খল (সাপস্নাই চেইন) বিঘ্নিত হলো। এরপর ২০২২ সালে শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এক লাফে অনেকখানি বেড়ে গেল, যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তরান্বিত করল।'

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের বিভিন্ন খাতে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। যেমন- গ্রিড বিদু্যতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য এবং ক্যাপটিভ বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর এখানেই রয়েছে সমাধানের পথ।

গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদু্যৎ উৎপাদনে জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহারের ফলে বছরে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস খরচ হয়। গত দশকে ক্যাপটিভ জেনারেশনের গড় দক্ষতা ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫.৩৮ শতাংশে উন্নীত হলেও এই খাতে আরও জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। দেখা গেছে, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি উলেস্নখযোগ্য অংশই এই জেনারেটর থেকে নির্গত তাপ কোনো উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারও করে না। তাই পুরনো ও অদক্ষ তথা ব্যয়বহুল জেনারেটরের বদলে জ্বালানি দক্ষ জেনারেটর লাগিয়ে এবং জেনারেটর থেকে নির্গত তাপকে কাজে লাগিয়ে আমদানি করা এলএনজির চাহিদা বছরে ৫০.১৮ বিলিয়ন ঘনফুট বা ২১ শতাংশ কমাতে পারে, যা বছরে ৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, জেনারেটর প্রতিস্থাপনের জন্য উলেস্নখযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও, এই মূলধন ব্যয় উঠে আসতে দেড় থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। আর জেনারেটর থেকে নির্গত তাপ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের জন্য করা বিনিয়োগ মাত্র এক বছরেই তুলে আনা সম্ভব হবে। তা না করলে, জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নতুন অবকাঠামোতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে, তাও এমন এক সময় যখন পরিবেশ-বান্ধব পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী নীতিমালা কঠোর হচ্ছে।

শফিকুল আলমের মতে, 'সাশ্রয়ী জ্বালানির যুগ শেষ হতে চলেছে, কারণ সরকার অদূর-ভবিষ্যতে আরও প্রতিযোগিতামূলক দামে জ্বালানি সরবরাহ করবে। ফলে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ শিল্প কারখানাগুলোকে অর্থসাশ্রয়ের দিক থেকে বেশি লাভবান করবে।'

জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীতিগত ভিত্তি বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই রচিত হয়েছে। যেমন, অনেক বেশি জ্বালানি ব্যবহৃত হয়- এমন স্থাপনা ও কারখানায় এখন জ্বালানি নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সম্প্রসারণের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত স্রেডা (টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) দ্রম্নত জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে দেশের জ্বালানি খাতকে আরও সুরক্ষিত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে বৃহত্তর সহায়তা, প্রণোদনা এবং অর্থায়ন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই গবেষক।

এসব বিবেচনায় এই প্রতিবেদনে সরকারকে মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি একটি পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- বৈদু্যতিক গ্রিডের আধুনিকায়ন করা, শিল্প-কারখানাগুলোকে ক্যাপটিভ বিদু্যৎ উৎপাদন থেকে ক্রমে সরে এসে বৈদু্যতিক গ্রিডের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে উৎসাহিত করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো।

কেবল গ্যাসভিত্তিক বেইজ লোড পস্ন্যান্টের পরিবর্তে কিছু (গ্যাসভিত্তিক) পিকিং পাওয়ার পস্ন্যান্ট তৈরি করা। যাতে জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোগ বাড়ানো হলে, এই পিকিং পাওয়ার পস্ন্যান্টগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির অনুপস্থিতিকালে বিদু্যৎ সরবরাহ করতে পারে। বিকল্পভাবে, পুরনো যে গ্যাস-চালিত কম্বাইন্ড-সাইকেল বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো ভবিষ্যতে বাতিল করা হবে, তাদের গ্যাস টারবাইনগুলো রেখে দেওয়া। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যখন ব্যবহার করা যাবে না, এই গ্যাস টারবাইনগুলো তখন বিদু্যৎ দিতে পারবে। সামগ্রিকভাবে শিল্পোৎপাদন জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহার থেকে সরে আসার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া। করপোরেট বিদু্যৎ ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রয়ে সুযোগ করে দেওয়া। এসব পদক্ষেপ ক্যাপটিভ উৎপাদনে দক্ষতাই বাড়াবে না, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনতে অনেক বেশি সহায়তা করবে।

শফিকুল আলম বলেন, 'পুরোপুরি নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা আমাদের জন্য অনেকটাই অসম্ভব, তবে নীতিমালা প্রণয়ন করে অবশ্যই আমদানি নির্ভরতায় লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। এতে বাংলাদেশের সময় লাগবে, তবে নীতিনির্ধারকদের এখনই পরিকল্পনা ও তৎপরতা শুরু করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ পরবর্তী বৈশ্বিক ধাক্কা সামাল দিতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে