ফুটপাত দখলদারদের তালিকা তৈরি নিয়ে ঠেলাঠেলি

যাদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করছেন। অনেকেই নানাভাবে কাজটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই নানা জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন

প্রকাশ | ১৩ মে ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
ঢাকার ফুটপাত দখলদারদের তালিকা তৈরিতে চলছে গড়িমসি। তালিকা তৈরির দায়িত্ব প্রাপ্তদের মধ্যে এ নিয়ে একপ্রকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রীতিমতো সমন্বয়হীনতার কারণে তালিকা তৈরির তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আজ উচ্চ আদালতে তালিকা দাখিলের কথা রয়েছে। আদালতের কাছে বাড়তি সময় চাওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন জানিয়েছেন, শুধু ঢাকা নয়, পুরোদেশের গুরুত্বপূর্ণ ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্য ফুটপাতের চাঁদা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। রোববার পর্যন্ত ঢাকার ফুটপাতের ১০ শতাংশের দখলদারদেরও তালিকা তৈরি হয়নি। এমনকি যাদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করছেন। অনেকেই নানাভাবে কাজটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই নানা জটিলতার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। দায়িত্বশীল একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে জানান, ঢাকার ফুটপাতের দখলদাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই কোনো সংস্থারই। ফুটপাতের দখলদারদের তালিকা তৈরিতে রীতিমতো ঠেলাঠেলি চলছে। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব অথবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ফুটপাত দখলদারদের তালিকা আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। ঢাকার ফুটপাত দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এমনকি রাস্তার দায়িত্বেও রয়েছে সিটি করপোরেশন দুটি। এখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিষয়টি অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েই তাদের কাজ শেষ করতে চাইছে। সূত্রটি বলছে, রাস্তার ফুটপাট ও রাস্তা বেদখল এবং সরকারি জায়গায় অবৈধ স্থাপনা তৈরির বিষয়টি সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি পুলিশও দেখে থাকে। মাঝে মধ্যেই সিটি করপোরেশন ঢাকার বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। কয়েক দিন পরেই অদৃশ্য হাতের ইশারায় আবারও গড়ে ওঠছে অবৈধ স্থাপনা। স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এসব গড়ে ওঠছে। যে কারণে ফুটপাত দখলকারীদের নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের মূল কাজই হচ্ছে ঢাকার যানজট নিরসন করা। এছাড়া পথচারীরা যাতে শৃঙ্খলার সঙ্গে রাস্তা পার হন। ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করেন। পাবলিক পরিবহণ নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা নামা করায়, সেটিই দেখভাল করার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। তিনি আরও বলেন, ফুটপাত দেখভাল করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। রাস্তাও সিটি করপোরেশন দেখভাল করে। শুধু মাত্র কোনো দোকান বা অবৈধ স্থাপনা ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তায় আসার পর তা ট্রাফিক পুলিশের আইন বা আওতায় পড়ে। রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কেউ কোনো কিছু করলে সেটি ট্রাফিক পুলিশ ছাড় দেয় না। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধতার সৃষ্টি করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অতীতেও উচ্চ আদালত ঢাকার ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তরফ থেকে উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়নি। আজ ১৩ মে উচ্চ আদালতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব অথবা স্থানীয় সরকারের সচিবের তরফ থেকে ঢাকার ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা দাখিল করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা মোতাবেক, আদৌ সেই দখলদারদের তালিকা উচ্চ আদালতে দাখিল করা হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে অবশ্যই উচ্চ আদালতের নির্দেশ মান্য করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা দাখিল করতে বাড়তি সময় প্রার্থনা করতে পারেন। এমনকি তা বিচিত্রও না। প্রসঙ্গত, মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) ২০২২ সালের নভেম্বরে উচ্চ আদালতে একটি রিট করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি করেন উচ্চ আদালত। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। আদেশে ঢাকার ফুটপাত দখল ও বিক্রির জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ৬০ অর্থাৎ দুই মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গটি তুলেন রিট আবেদনকারী পক্ষ। উচ্চ আদালত ঢাকার ফুটপাত দখল ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা এবং ফুটপাত দখল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। গত ২৯ এপ্রিল বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা করে জমা দিতে বলেন। এদিন আদালতে আবেদনকারীপক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। উচ্চ আদালত স্বরাষ্ট্র সচিব অথবা স্থানীয় সরকার সচিবকে নামের তালিকা হলফনামা আকারে আগামী ১৩ মের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেন।