চট্টগ্রামে চার সংগ্রামী নারীর সফল মা হয়ে ওঠার গল্প

প্রকাশ | ১২ মে ২০২৪, ০০:০০

সনজীব নাথ, চট্টগ্রাম
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'নারী' কবিতায় লিখেছেন, 'বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' চট্টগ্রামে চার পরিবারে মিলেছে এমন চার নারী, যাদের গল্পে মিলেছে কবির এই চরণের চিরন্তন বাস্তবতা। যে পরিবারে সন্তানদের গুণে গুণান্বিত এই চার মা। রোকেয়া বেগম সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে সফল মা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসাইনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। যিনি গত বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এবং বেগম রোকেয়া দিবসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছ থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় সফল জননী নারীর শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সফল জননী রোকেয়া বেগম জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। যুদ্ধের কারণে তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এর পাঁচ বছর পর মারা যান তার বাবা। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসাইনের সঙ্গে। বিয়ের পাঁচ বছর পর তাদের ঘরে আসে প্রথম কন্যাসন্তান। বছর না যেতেই মারা যায় সেই কন্যাশিশু। এরপর আবারও তিনি আরেক কন্যাশিশুর জন্ম দেন। কিছুদিন পর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে সেই কন্যাও মারা যায়। বিয়ের ঠিক ১৬ বছরের মধ্যে তাদের সংসারের জন্ম নেয় এক ছেলে ও দুই কন্যা। এর কয়েক বছর পরই প্যারালাইজড রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার স্বামী। ছোট্ট তিন শিশুকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবনযুদ্ধে। পরিবার ও তিন সন্তানের সব খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। তাই নিজে কিছু করার চেষ্টা করেন। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, শাকসবজির আবাদ করে বাড়তি টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করেন। এই টাকা দিয়েই তিনি সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ মিটিয়েছেন। রোকেয়া বলেন, 'নিজে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তিন সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা ছিল বেশি। সেই সন্তানরা এখন আলো ছড়াচ্ছে দেশের হয়ে। সংসারের অভাবের মধ্যে তিন সন্তানের মধ্যে দু'জনকে গড়ে তুলেছি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হিসেবে। বড় মেয়ে আইরিন আকতার রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যলয়ে রয়েছে রাজস্ব শাখার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে। ছেলে মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন শাখা) সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ছোট মেয়ে নাসরিন সুলতানা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল থেকে এসবিবিএস পাস করে ৩৯তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার ওসমানী মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের এমডিএমএসে অধ্যয়নরত।' ফেরদৌস আক্তার বেকার স্বামী নিয়ে দুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামের সফল মা ফেরদৌস আক্তার। তার দুই সন্তানের মধ্যে এক ছেলে নওশের ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আরেক ছেলে জামশেদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছেন। স্থানীয়রা জানান, ফেরদৌস আক্তার ছিলেন একজন গৃহিণী। স্বামী, সংসার, সন্তান সামলিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। ২০ সালের করোনাকালে স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাত্র ১০ কেজি মরিচের গুঁড়া দিয়ে অনলাইনে মসলার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। যার আয় দিয়ে চলছে পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। তিনি একজন গর্বিত মা। কিন্তু ফেরদৗস বেগমের ভাষ্য, গর্ববোধ করার মতো এখনো কিছুই তার অর্জন হয়নি। সন্তানরা দেশের কাজে না লাগা পর্যন্ত নিজেকে একজন সফল মা হিসেবে দেখতেও রাজি নন তিনি। সন্তানের সাফল্যের জন্য তিনি বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানান। ফেরদৌস আক্তার চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গশ্চি মাঝিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল কলেজে। পলিটেকনিক্যালে পড়াকালে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের লুৎফুল বারি পারভেজের সঙ্গে বিয়ের বেড়াজালে আটকে পড়েন ফেরদৌস আক্তার। ফলে থমকে যায় তার শিক্ষাজীবন। তখন থেকেই তার স্বপ্ন জাগে উদ্যোক্তা হওয়ার। বৈবাহিক জীবনে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। বর্তমানে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামে সুখেই দিনাতিপাত করছেন তিনি। ফেরদৌস আক্তার এখন স্বপ্ন দেখছেন, একজন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার এবং রাঙ্গুনিয়ায় আধুনিক একটি মসলা কারখানা স্থাপনের। সেই লক্ষ্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, 'আমার প্রতিষ্ঠানের নাম 'কুক মাসালা'। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রাম থেকে আমি 'উই'-এর (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করছি। আমার প্রতিষ্ঠান কুক মাসালার প্রোডাক্ট দেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে এখন বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে। হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচের গুঁড়ার চাহিদা বেশি ক্রেতাদের। শিখা দাশ চৌধুরী চট্টগ্রামের আরেক সফল মা শিখা দাশ চৌধুরী। তার গ্রামের বাড়িও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র জামাল খান লেনের পৈতৃক বাড়িতে। বাবা সন্তোষ ভূষণ দাশ একজন আইনজ্ঞ, রাঙ্গুনিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং সরকারের কর্মকমিশনের সদস্য। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া শিখা শৈশব-কৈশোর পার করেছেন অন্য দশটি সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার মা রেণুকা প্রভাদাশ অসুস্থ হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৮১ সালে বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামী নীতিশ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকার সাভারের গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে যোগদেন। ১৯৮২ সালে শিখা এক সন্তানের মা হন। এরই মধ্যে তার শিক্ষাজীবনে টানাপড়েন শুরু হয়। লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। তবে সুহৃদ- সহপাঠীর সাহায্যে সাবসিডিয়ারি পাস করেন। এরপর তার স্বামী পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য প্যারিস যাওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সম্পন্ন করেন বিএড ডিগ্রি। স্বামীর চাকরির সুবাদে বিভিন্ন স্থানে বাস করতে হলেও তিনি ১৯৮৯ সালে পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে যোগ দেন কর্মকর্তা হিসেবে। চাকরি জীবনের পালা বদলের অস্থির সময়ে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান ধীমান। শিখার দুই সন্তান দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠেছে। কন্যা নিশি ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করে তার পেশাগত জীবনকেও সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। আর পুত্র ধীমান বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পড়াশানার সুযোগ পায়। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে শিখা এখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে (কাওরান বাজার অফিস) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগত জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। উম্মে হাবিবা ফারজানা চট্টগ্রামের আরেক সফল মা উম্মে হাবিবা ফারজানা। তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা। পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনি আজ সফল। তার এ সফলতার পেছনে অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। প্রায় চার বছর পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও শুধু দৃঢ় মনোবল আর পরিশ্রমের কারণেই সফল এই তরুণী। ৩৭তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ফারজানা। ২০০৭ সালে এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ক্যাম্পাসের রঙিন দিনগুলোর স্বাদ বুঝে উঠতে না উঠতেই অনার্স দ্বিতীয়বর্ষে পড়াকালেই মা-বাবার ইচ্ছায় বেসরকারি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ের পর সাংসারিক বাস্তবতায় রঙিন জীবন কিছুটা ফ্যাকাসে লাগতে থাকে পড়াশোনা, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সবকিছু সামলে হাঁপিয়ে উঠতে উঠতে। তবে এক সময় আত্মবিশ্বাস দিয়ে জয় করেন সবকিছু। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় আট মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন হাবিবা। কন্যার জন্মের পরই শুরু হয় তার প্রকৃত জীবন সংগ্রাম। সন্তান হওয়ার পর প্রায় কারও সাহায্য ছাড়াই একা বড় করে তুলতে থাকেন মেয়ে মানহা ইসলাম শাইরাকে। সে সময়টা সবকিছু সামলে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়েও সন্তানের ওপর প্রভাব পড়তে দেননি তিনি। ফারজানার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা সর্বোপরি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেই তার সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা। সেজন্য চলমান জীবন সংগ্রামের মধ্যেই নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে চার বছর পর শুরু করেন পরীক্ষার প্রস্তুতি। লিখিত পরীক্ষার আগে তিনি পড়ালেখার সুযোগ পান মাত্র দেড় মাস। লিখিত পরীক্ষায় সফলতার পর ভাইভাতেও সফল হন ফারজানা। সুপারিশপ্রাপ্ত হন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে। তার এ সফলতায় আপস্নুত তার পরিবার ও স্বজনরা। আর নিজস্ব পরিচিতি তৈরি হওয়ায় আপস্নুত ফারজানাও। নারীদের উদ্দেশ্যে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত উম্মে হাবিবা ফারজানা বলেন, 'সফলতার জন্য নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। আমি মানুষ, আমি একটা আলাদা সত্তা। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর এজন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো পরিশ্রম। সে বিষয়ে কখনোই পিছপা হওয়া যাবে না।'