অপরিণত শিশুমৃতু্যর লাগাম টানার বড় চ্যালেঞ্জে দেশ

প্রকাশ | ০৯ মে ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য থেকে এক মাস বয়সি শিশুমৃতু্য হার প্রতি হাজারে ১২ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে, দেশে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুমৃতু্য হার প্রতি হাজারে ৩৮ জন। এর মধ্যে একটি বড় অংশই অপরিণত নবজাতক (প্রিম্যাচুউরড বেবী)। যার ১৬.২০ শতাংশের মৃতু্য ঘটছে মাতৃদুগ্ধের অভাবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, জন্মের সময় মায়ের মৃতু্যর কারণে অনেক শিশু মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয়। মায়ের অসুস্থতা বা শারীরিক সমস্যার কারণে অনেক শিশু সঠিক মাত্রায় দুধ পায় না। এই শিশুরা পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিণত সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের বুকের দুধ পান করতে না পেরে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক নবজাতকের মৃতু্য ঘটছে। অন্যদিকে প্রতিবছর দেশে অনেক নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এই শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতেও মাতৃদুগ্ধ জরুরি হয়ে পড়ে। অনেক সময় তা সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাদের একটি বড় অংশের অকাল মৃতু্য ঘটে। অথচ মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা 'হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক' নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে রাজধানীর মাতুয়াইলের মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে প্রায় চার বছর ধরে পড়ে আছে দেড় কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। জন্মের সময় মা-হারা কিংবা অন্য কোনো কারণে মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত নবজাতকদের মাতৃদুগ্ধ সরবরাহের লক্ষ্যে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুর জন্য নিজ মায়ের দুধ সংরক্ষণও ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য। বিষয়টি ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিবেচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত চাওয়া হয়। দীর্ঘদিনও সুনির্দিষ্ট জবাব না পাওয়ায় থমকে আছে উদ্যোগটি। বুধবার চতুর্থ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অ্যান্ড সাইন্টিফিক সেমিনার অব বাংলাদেশ প্রিনেটাল সোসাইটি ২০২৪-এর পলিসি সেশনে 'রিলিজিয়াস কমপেস্নইন্ট হিউম্যান মিল্ক স্টোরেজ অ্যান্ড ডোনেশন ইন বাংলাদেশ- হাউ টু ওভারকাম দ্য চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক আলোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে। তবে এই সম্মেলন অংশ নেওয়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মুহাম্মদ বশিরুল আলম জানান, এ ধরনের কোনো চিঠি তার নজরে আসেনি। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ উলেস্নখ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে এর আগে এ ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা, তা জানা জরুরি বলে জানান। ড. বশিরুল আলম আরও বলেন, কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে শুধু অনুমোদনই দেবে না, বরং সচেতনতা ও প্রচারণা চালানোর ব্যাপারেও পূর্ণ সহযোগিতা করবে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়া ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. মশিউর রহমান মোলস্না সজল বলেন, তার নির্বাচনী এলাকার একটি হাসপাতালে দেশের প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি গর্বিত। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি সংসদে আলোচনা করবেন। প্রয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলবেন। নবজাতকের মৃতু্যর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মজিবুর রহমান বলেন, মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত মৃতু্যঝুঁকিতে শিশুমৃতু্যরোধে বিনামূল্যে মাতৃদুগ্ধ সরবরাহে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এতে যাতে কোনোভাবেই ধর্মীয় অনুশাসনের ভঙ্গ না হয়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা সংরক্ষণ করে একজন মায়ের বুকের দুধ একজন শিশুকেই পান করানো হবে। ভবিষ্যৎ বৈবাহিক সম্পর্ক নিরাপদ রাখার স্বার্থে দুধমাতা ও দুধ গ্রহণকারী শিশুর দ্বিপক্ষীয় পরিচিতি এবং সম্পর্ক পুরোপুরি সংরক্ষণ করার প্রস্তুতি নেওয়া আছে। ডা. মজিবুর রহমান আরও জানান, দেড় কোটি টাকায় মায়ের দুধ পাস্তুরাইজিং মেশিন, অত্যাধুনিক ফ্রিজসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনা হয়। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে যন্ত্রপাতিগুলো স্থাপন এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০২১ সালে এটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুমোদন না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অথচ পরে উদ্যোগ নিয়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০২২ সালের অক্টোবরে 'হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের' কার্যক্রম চালু করেছে মালয়েশিয়া। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত ও দুবাইতেও এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এই সম্মেলনের মালয়েশিয়া, কুয়েত ও ইরাকের তিনজন ফরেন ডেলিগেটস অংশ নেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে তারা তাদের দেশে কীভাবে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেন। ফরেন ডেলিগেটসরা মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়টিও সবিস্তারে তুলে ধরেন। সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রফেসর লায়লা আরজুমান্দ বানু, প্রফেসর মুহাম্মদ শহীদুলস্নাহ, প্রফেসর ফেরদৌসী বেগম, প্রফেসর সঞ্জয় কুমার দে, প্রফেসর হামিজাহ বিনতে ইসমাইল, ডা. রিহাব মুহাম্মদ কাদেরসহ আরও খ্যাতনামা কয়েকজন চিকিৎসাবিদ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে অপরিণত শিশুমৃতু্যর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে দাবি করেন তারা।