দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ঘোষিত হালদা নদীতে অল্প পরিমাণে ডিম ছেড়েছে কার্পজাতীয় মা মাছ। ১০-১১টি নৌকার সংগ্রহকারীরা ২০-২৫ কেজি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। সবমিলিয়ে ২৫০ কেজির মতো ডিম সংগ্রহ হয়েছে। তবে পুরোদমে ডিম সংগ্রহের জন্য হালদা নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছেন পাঁচশতাধিক ডিম সংগ্রহকারী।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম মশিউজ্জামান বুধবার দুপুরে এতথ্য নিশ্চিত করে জানান, গত সোমবার চট্টগ্রামে বজ্রসহ দমকা ও ঝড়ো-হাওয়া বয়ে যায়। এরপর হালদা নদীতে কিছুটা ঢলের সৃষ্টি হয়। ফলে সোমবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত মা মাছ নদীর বিভিন্ন স্থানে স্বল্পহারে ডিম ছাড়ে।
নদীতে ব্যাপকভাবে ঢলের সৃষ্টি হলে মা মাছ পুরোপুরি ডিম ছাড়বে। আর সেই অপেক্ষায় হালদা নদীর পাড়ে অপেক্ষায় রয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। ডিম সংগ্রহকারীরা বলেন, ইংরেজি এপ্রিল মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযুক্ত মৌসুম। কিন্তু দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত এপ্রিল মাসে দুইটি তিথি চলে গেলেও মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়েনি।
ইউএনও এবিএম মশিউজ্জামান আরও বলেন, গত ক'দিন থেকে দিনের বেলায় ও রাতে হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি বিভিন্নস্থানে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হয়েছে। তা ছাড়া গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দমকা-হাওয়া, বজ্রসহ প্রবল বর্ষণ হওয়ায় হালদা নদীতে ঢলের সৃষ্টি হয়। ফলে হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাশ মুন্সির হাট, মাছুয়াঘোনা, আমতুয়া গড়দোয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকার কিছু অংশে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ।
ডিম সংগ্রহকারী পাকিরাম দাশ, হরিজন দাশ, সন্তোষ দাশ, সুজিত দাশ ও সুনিল দাশ জানান, তারা প্রায় ১১টি নৌকায় ডিম সংগ্রহ করেছেন। এতে প্রতিটি নৌকায় দুই থেকে আড়াই বালতি (এক বালতিতে ১০ কেজি) ডিম সংগ্রহ করেছেন। সবমিলিয়ে আনুমানিক ২৫ বালতির বেশি কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন তারা।
রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুলা আল মামুন বলেন, এবার এখন পর্যন্ত মাত্র ১১টি নৌকায় প্রতিটিতে দু'জন করে ২২ জন লোক ডিম সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি নৌকায় দুই থেকে আড়াই বালতি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। সে হিসাবে ১১টি নৌকায় ২৫০ কেজি পর্যন্ত কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম সংগ্রহ করা গেছে।
তিনি আরও বলেন, আগেই বলা হয়েছিল যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকে অর্থাৎ বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামে তাহলে চলতি মে মাসের অমাবস্যার জোঁ অথবা পূর্ণিমার জোঁতে (২০ মে থেকে ২৫ মে) হালদা নদীতে মেজর কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ৫০০ থেকে ৬০০ জন স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী নৌকা নিয়ে পুরোদমে ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণতে শুরু করেছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাউজানের পশ্চিম গহিরা অংকুরী ঘোনা, পশ্চিম গহিরা বড়ুয়াপাড়া, দক্ষিণ গহিরা, গহিরা মোবারক খীল, গহিরা জামতল, পশ্চিম বিনাজুরী, কাগতিয়া, আজিমের ঘাট, মগদাই, নাপিতের ঘাট, পশ্চিম আবুর খীল, খলিফার ঘোনা, উরকিরচর, সার্কদা মোকামীপাড়া কচুখাইন, হাটহাজারীর গড়দুয়ারা, নয়াহাট, আমতোয়া, বাড়িঘোনা, মাছুয়া ঘোনা, পোরালীর মুখ, দক্ষিণ মাদারসা এলাকার নদীতীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা ও জাল নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন।
আজিমের ঘাট এলাকার বাসিন্দা চন্দন জলদাশ বলেন, ডিম সংগ্রহ করতে চারটি নৌকা প্রস্তুত রেখেছি। এছাড়া ডিম ফুটানোর জন্য আজিমের ঘাট এলাকায় মাটির কুয়া খনন করে রাখা হয়েছে। প্রবল বর্ষণ ও বজ্রপাত হলে নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে অমবস্যা ও পূর্ণিমায়।
তিনি বলেন, ডিম সংগ্রহকারীরা ইতোমধ্যে মাটির কুয়া খনন করে রেখেছেন। যেখানে ডিম ফুটিয়ে রেণু উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মৎস্য প্রকল্পের মালিক ও মৎস্য চাষিদের কাছে বিক্রি করবেন। মৎস্য চাষিরা পুকুর, জলাশয় ও হ্যাচারিতে মাছের চাষ করে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করে।
রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ অফিসের তথ্যমতে, হালদা নদীতে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় যেমন রয়েছেন সংগ্রহকারীরা। তেমনি ডিম ফুটানোর জন্য রাউজানের পশ্চিম গহিরা, কাগতিয়া, গহিরা মোবারক খিল, হাটহাজারীর মদুনাঘাট, মাছুয়াঘোনা ও মাদ্রাসা এলাকায় সাতটি হ্যাচারি নির্মাণ করা হয়।
এর মধ্যে হাটহাজারীতে চারটি ও রাউজানের গহিরা মোবারক খিল, রাউজানের পশ্চিম বিনাজুরী আইডিএফর একটি হ্যাচারি সচল রয়েছে। পশ্চিম গহিরা ও কাগতিয়ার দুটি হ্যাচারি অকেজো হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। ডিম ছাড়ার মৌসুম হওয়ায় নদীতে সব ধরনের যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা প্রশাসন, নৌ-পুলিশ নদীতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানে বিপুল পরিমাণ জাল উদ্ধার করা হয়েছে। পশ্চিম গহিরা ও কাগতিয়ায় দুটি হ্যাচারির পুননির্মাণকাজ আগামী বছর শেষ হবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, হালদা নদীতে চলছে মেজর কার্পজাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা (৫০ বছরের মধ্যে অধিক) ও ব্রজসহ বৃষ্টিপাতর অভাবে হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় বিগত এপ্রিল মাসের দুটি জোঁতে (অমাবস্যার ও পূর্ণিমার) ডিম ছাড়েনি কার্পজাতীয় মা মাছ।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন. গত ১ মে হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্র মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী কি না জানতে হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ড সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তা সরাসরি হালদা নদীতে ও বাসার নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় তিনি দেখেন, পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের আদর্শ মানের মধ্যে রয়েছে। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার পানির তাপমাত্রা আদর্শমান ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে ৩৩ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়েছে।
এই হালদা গবেষক বলেন, মেজর কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মেজর কার্পজাতীয় মাছের জন্য অত্যানুকূল পানির তাপমাত্রা হচ্ছে (২২-৩০) ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এরা অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বৃষ্টিপাত হলেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।