সিআইডি পুলিশের অনুরোধে কিরগিজস্তানে পাচার হওয়া বাংলাদেশিদের উদ্ধারে তাৎক্ষণিকভাবে হস্তক্ষেপ করল জাতিসংঘ। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটিতে পাচার হওয়াদের মধ্যে ছয় জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের আটকে রাখা হয়েছে দেশটির রাজধানী বিশকেকের একটি হোটেল কক্ষে। সেখানে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে বলে পাচার হওয়াদের একজনের বর্ণনায় ওঠে এসেছে। তাদের দ্রম্নত দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
বুধবার এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, 'মানবপাচার মামলায় ঢাকার নয়াপল্টনের 'জান্নাত ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল' নামের ওই এজেন্সি থেকে সিআইডি পুলিশ প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইব্রাহিম মলিস্নক নাহিদ (৩৫) এবং তার দুই সহযোগী শারমিন হোসেন লাবণী (৩৬) ও আরিফুর রহমান সাদীকে (২৪) গ্রেপ্তার করে। মঙ্গলবার বিকালেই তাদের ঢাকার সিএমএম আদালতে সোর্পদ করা হয়। আসামিরা স্বেচ্ছায় বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালতের নির্দেশে রাতেই তাদের ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলাটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে ওঠে এসেছে মানবপাচারের লোমহর্ষক কাহিনী ও অভিনব সব কৌশলের তথ্য। গ্রেপ্তাররা পেশাদার মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। চক্রটির বাংলাদেশি সদস্য রয়েছে কিরগিজস্তানেও। তারা ভালো বেতনে দেশটিতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকর্ষণীয় ভিডিও বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব ও ফেসবুকে ছেড়ে দিত। সেই ফাঁদে যারা পড়তেন, তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ করে টাকা নিতেন। এরপর কিরগিজস্তানে থাকা তাদের লোকজন দেশটির ভিসার কপি ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখাতেন। এভাবেই গ্রাহকদের মনে বিশ্বাস স্থাপন করত চক্রটি। আর সেই বিশ্বাসকেই কাজে লাগিয়ে কিরগিজস্তানে মানবপাচার করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের নভেম্বরে সরকার কর্তৃক 'টু্যরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি' হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। আইন অনুযায়ী এজেন্সিটি টু্যরিস্ট ভিসায় মানুষকে বিদেশে পাঠাতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই মানুষকে কাজের জন্য বিদেশে পাঠাতে বা জনশক্তি রপ্তানি করতে পারে না। প্রতিষ্ঠানটি বেআইনিভাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার শুরু করে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে এখন পর্যন্ত ৬ জন বাংলাদেশিকে প্রতিষ্ঠানটি কিরগিজস্তানে পাচার করেছে বলে তথ্য প্রমাণ মিলেছে। এমনকি জবানবন্দিতেও ৬ বাংলাদেশিকে পাচারের প্রসঙ্গটি এসেছে। পাচারের শিকার হওয়া ছয় জনের নাম ঠিকানাও পাওয়া গেছে'।
তিনি আরও জানান, প্রাপ্ত তথ্যের সূত্রধরে পাচারের শিকার হওয়া ছয় বাংলাদেশি কিরগিজস্তানের কোথায় রয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেয়া হয়। শেষ ভরসা হিসেবে বেছে নেয়া হয় পার্শ্ববর্তী একটি দেশের দূতাবাস ও জাতিসংঘকে। কারণ কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে বিশ্বের ২৩টি দেশের দূতাবাস থাকলেও বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা চ্যান্সারি অফিস নেই। জাতিসংঘ তাৎক্ষণিকভাবে পাচারের শিকার হওয়া বাংলাদেশিদের উদ্ধারে হস্তক্ষেপ করে। পাচার হওয়াদের শনাক্তে জাতিসংঘ ও পার্শ্ববর্তী একটি দেশের দূতাবাস ছাড়াও কিরগিজস্তানের সরকার, দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা সার্বিক সহায়তা করে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাচার হওয়াদের মধ্যে মিনার হোসেন সানি (৩০), লিটন (৩২), জনি (২৮), জুলহাস (২৫), ইয়াসিন (৩১) ও মাজহার ওরফে মারুফ (২৭) নামের ছয় বাংলাদেশিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এই কর্মকর্তা জানান, বুধবার দুপুর নাগাদ ছয় বাংলাদেশির সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তারা দেশটির রাজধানী বিশকেকের একটি হোটেল রুমে আছেন। সেখানে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। হোটেলে থাকাদের মধ্যে একপর্যায়ে মিনারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সংশ্লিষ্টদের।
মিনারের বক্তব্য মোতাবেক, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে জান্নাত ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে কিরগিজস্তান থেকে ভিডিও কলের মাধ্যমে তার ভিসার কপি দেখানো হয়। ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেয়ার পর এজেন্সিটি তাকে চলতি বছরের ১ ফেব্রম্নয়ারি কিরগিজস্তানে পাঠায়। সেখানে তার ফল প্যাকেটজাত করার কথা। সেখানে যাওয়ার পর তাদের ওই হোটেলটির একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। নেওয়ার পর তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে যায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। সেই থেকে তারা কক্ষটিতে বন্দি। প্রতিদিন সেখানে ৫ থেকে ৭ মার্কিন ডলার খরচ হয়। অর্থের সুনির্দিষ্ট কোনো জোগান না থাকায় কোনো কোনো দিন তাদের না খেয়ে থাকতে হয়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিআইডির মানবপাচার ও প্রতিরোধ সেলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহ্জাহান হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে যায়যায়দিনকে বলেন, কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের একটি হোটেলে পাচার হওয়াদের মধ্যে ৬ বাংলাদেশির অবস্থান সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের মধ্যে মিনারের সঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছে। মিনারের বর্ণনা মোতাবেক এজেন্সিটির মাধ্যমে দেশটিতে পাচার হওয়া ৬ বাংলাদেশিকে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পাচারের শিকার ছয় জনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সিআইডি, পুলিশ সদর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও জাতিসংঘ, কিরগিজস্তান সরকার, দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। অত্যন্ত দ্রম্নততার সঙ্গে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এজেন্সিটির মাধ্যমে আরও কোনো দেশে মানবপাচারের ঘটনা ঘটেছে কিনা, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এজেন্সিটি বিভিন্ন দেশে পাঠানোর জন্য আরও ৩৫ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ করে টাকা নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। পাচার হওয়া ছয় জনের কাছ থেকেও এজেন্সিটি প্রায় ৩৫ লাখ টাকা নিয়েছে।
সিআইডির অ্যাডিশনাল এসপি আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মূলত চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ঢাকার পল্টন মডেল থানায় রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানাধীন নলিয়া পাড়ার বাসিন্দা রিকশা চালক মোহাম্মদ সোনা মিয়ার (৫৯) দায়ের করা মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় গ্রেপ্তার করা হয় মানবপাচারকারী চক্রের ওই তিন সদস্যকে। সোনা মিয়া বাড়ি ঘর, জমা জমি, গৃহপালিত পশু বিক্রি করে জমানো টাকা দিয়েছিলেন এজেন্সিটিকে। কিরগিজস্তানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশের মাধ্যমে এজেন্সি কর্তৃক প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। পরে তিনি ঢাকার পল্টন মডেল থানায় ওই মামলাটি দায়ের করেন।