বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১
ভুক্তভোগীদের বিস্ময়

চট্টগ্রামে পুলিশের মদদে বেপরোয়া ভূমিদসু্য চক্র

'দিন দিন বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। নগরীর চান্দগাঁও থানার উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকায় এমন নানা অপরাধ কর্মকান্ডে সক্রিয় তারা'
চট্টগ্রাম র্অফিস
  ০৭ মে ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রামে পুলিশের মদদে বেপরোয়া ভূমিদসু্য চক্র

জাল কাগজ সৃজনের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। করেন ইয়াবাসহ নানা রকম মাদক ব্যবসা। পরিচালনা করেন কিশোর গ্যাং। এসব থেকে আয়ের অর্থ করেছেন পাচার। এসব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কারণে প্রতিবাদী মানুষের গরু ও হাঁস-মুরগির খামার এবং পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি করেছেন।

এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও এদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ। বরং দিনের বেলায় ইয়াবাসহ ধরেও রাতে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকলেও পুলিশ ফিরেও তাকাচ্ছে না এসব অপরাধ চক্রের দিকে। জাল কাগজে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির ঘটনায় থানায় দায়ের করা মামলার বিষয়ে গত ৫ মে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তার সঙ্গে ছিলেন আসামিরাও। যা সিসিটিভি ফুটেজে দৃশ্যমান।

আর এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী স্থানীয়রা। একই সঙ্গে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে ভূমিদসু্য অপরাধ চক্র। চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও থানার উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকায় এমন নানা অপরাধ কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিদসু্য অপরাধ চক্র।

তাদের মতে, অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির অভিযোগে এই ভূমিদসু্য অপরাধ চক্রের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের চান্দগাঁও ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা মো. ইমাম উদ্দিন বাদি হয়ে রোববার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে একটি অভিযোগ দায়ের করে। যা গড়িমসি শেষে মামলা হিসেবে নেন চান্দগাঁও থানার পুলিশ।

মামলায় আসামিরা হলেন- বড়বাড়ী নাথ পাড়া এলাকার বাসিন্দা ভূমিদসু্য অপরাধ চক্রের মূল হোতা তপন কুমার নাথ (৬৪). স্বপন কুমার নাথ (৬২) পিতা- মৃত শুবল চন্দ্র নাথ, শিমুল কান্তি নাথ (৫০), পিতা- হিমাংশু বিমল নাথ, কৃষ্ণ নাথ (৩৫), পিতা- বিশ্বেসর নাখ, কমল দেবনাথ (৪৪), পিতা- হিমাংশু বিমল নাথ, রুপন দেবনাথ (৪৬), পিতা- মৃত নিকুঞ্জ দেবনাথ, দেবরাজ নাথ (২৪), পিতা- দুলাল নাথ, সুভাষ চন্দ্র দেবনাথ (৫৬), শংকর দেবনাথ (৫৩), তাপস দেবনাথ (৪৯), পংকজ দেবনাথ (৫১) ও সানু বিশ্বাস (চন্দন) (৫২)।

অভিযোগে বলা হয়, চান্দগাঁও মৌজার সাবেক পাঁচলাইশ বর্তমানে- চান্দগাঁও থানাধীন চট্টগ্রাম জেলার পি.এস ৬১৭ নং খতিয়ানের পি.এস ১৬৬৭ দাগের সামিল বি.এস ৩০০৪ নং খতিয়ানের বি.এস ১২৬৮ দাগের ০.০১৪ একর সম্পত্তির আন্দর ০.০৭ একর ও বি.এস ১২৮৩ দাগসহ অন্যান্য দাগাদির আন্দর মোট ১.৫৫৫০ একর জমি ভি.পি. মামলা নং- ৮০/৮০-৮১ ৮৩/৮১-৮২ মূলে ক তফসিলে গেজেটভুক্ত গেজেটের ৯২৪৮ ও ৯২৪৯ নং পৃষ্ঠায় ২৮৯ নং ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তি হয়।

উক্ত সম্পত্তি ভি.পি সম্পত্তিতে সরকারের যাবতীয় স্বত্ব, স্বার্থ দখল নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান থাকাবস্থায় উপরোক্ত ১-৪ নং বিবাদীগণ বেআইনিভাবে সরকারি স্বার্থযুক্ত আইন অনুযায়ী গেজেটভুক্ত হিসেবে লিপি বলবৎ সম্পত্তির দাতাগ্রহীতা সাজিয়া এবং ৫-১২ নং বিবাদীগণ সাক্ষী শনাক্তকারী ও দলিল লেখক হইয়া পরস্পর অপযোগসাজশে তথ্য গোপন করিয়া মিথ্যা বিবরণ সম্বলিত তথ্য প্রদান করে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বর্ণিত ভি.পি মামলা মূলে সরকারি ক তালিকা গেজেটভুক্ত ভি.পি মামলা নং ৮৩/৮০-৮১ মূলে সরকারের ভি.পি. সম্পত্তির উপর বি.এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০১৭১ একর জমি উলেস্নখ করে গত ২২ সালের ১৮ অক্টোবর চান্দগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত ৬১৭৪ নং বিক্রীত দলিল সৃজন করেন।

বর্ণিত ৬১৭৪ নং রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে ১ নং ও ২ নং বিবাদীগণ আইনগতভাবে অবমুক্তবিহীন ওয়ারিশ উলেস্নখ করে দাতা ও ৩নং বিবাদীগ্রহীতা হিসাবে এবং ৫-৭ নং বিবাদীগণ সাক্ষী শনাক্তকারী ও ১২ নং বিবাদী দলিল লিখক হইয়া পরস্পর যোগসাজশে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে সরকারি সম্পত্তি বেআইনিভাবে গ্রাস করার কু-উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বর্ণিত জাল দলিল সৃজন করেন।

একই প্রকারে বর্ণিত ভি.পি মামলাভুক্ত বি.এস ১২৮৩ দাগের আন্দর ০.০১৬০ একর ভি.পি সম্পত্তি নিয়ে গত ২২ সালের ১৩ নভেম্বর চান্দগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত ৬৮১৯ নং আরেকখানা বিক্রীত দলিল সৃজন করেন। বর্ণিত ৬৮১৯ সং রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে একইভাবে ১ নং ও ২ নং বিবাদীগণ দাতা, ৪ নং বিবাদীগ্রহীতা, ৮-১১ নং বিবাদীগণ সাক্ষী শনাক্তকারী ও ১২ নং বিবাদী দলিল লিখক হইয়া পরস্পর যোগসাজশে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে সরকারি সম্পত্তি বেআইনিভাবে গ্রাস করার কু-উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বর্ণিত জাল দলিল সৃজন করেন।

এ অবস্থায় অভিযোগ তদন্ত করার আবেদন চেয়ে মামলার এজাহারটি আদালতে পাঠায় বলে জানান চান্দগাঁও থানার ওসি জাহেদুল কবির। তিনি বলেন, 'মামলাটি আমরা তদন্ত করব। তদন্তে অভিযোগ যদি সত্য হয় তারপর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেব।' কিন্তু মামলার বাদির তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের চান্দগাঁও ভূমি সার্কেল অফিসারের তদন্তে জাল কাগজে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির বিষয়টি উঠে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে ওই অর্পিত সম্পত্তি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের। কিন্তু জাল কাগজে ওই জমি বিক্রির মাধ্যমে জবরদখল করার দায়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

এছাড়া ওই অর্পিত সম্পত্তির ওয়ারিশ হিসেবে ভুক্তভোগী পক্ষ গত ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের জুডিশিয়াল বেঞ্চ বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের আদালতে এ বিষয়ে একটি রিট করেন। জুডিশিয়াল বেঞ্চের বিচারপতি অর্পিত সম্পত্তি বিক্রয় ও ভোগ দখলের দায়ে বিবাদীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভিপি শাখাকে আদেশ দেন।

আদেশের কপি গত ২১ জানুয়ারি রিসিভ করেন ভিপি শাখা। সেই থেকে গত দুই মাস অতিবাহিত হলেও উচ্চ আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং ভিপি শাখার অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন ও মো. হেনাসহ অর্পিত সম্পত্তি শাখার একাধিক কর্মকর্তা তপন কুমার নাথ ও স্বপন কুমার নাথের নেতৃত্বে পরিচালিত ভূমিদসু্য সিন্ডিকেটকে কুটবুদ্ধি প্রদান করেন।

তবে গত ১৮ এপ্রিল 'চট্টগ্রামে ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির অভিযোগ' শিরোনামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক যায়যায়দিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যা সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। ফলে ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য লিখিত নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নির্দেশনা পাওয়ার পর দ্রম্নত সময়ের মধ্যে চান্দগাঁও থানায় এই মামলা দায়ের করা হয় বলে জানান মামলার বাদি ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ইমাম উদ্দিন।

তিনি বলেন, জাল কাগজ সৃজনের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রীর বিষয়ে ভূমিদসু্য চক্রের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেইসসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল। তাছাড়া এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির ওপর দেশের জাতীয় দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। এরপর জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ২৮ এপ্রিল চান্দগাঁও থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু অভিযোগ দায়েরের সময় হাইকোর্টের রিটের আদেশ এবং ভূমি সার্কেলের তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো কপি নেননি। শুধুমাত্র এজাহারের কপি নিয়েছেন। যা আদালতে পাঠিয়েছেন বলে জানান চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এজাহারকে মামলা হিসেবে আদালতে পাঠিয়েছি। আদালতের নির্দেশে তদন্ত করা হচ্ছে।'

এ বিষয়ে জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার উপপরিদর্শক মোমিনুল হাসানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে মামলার বাদি ভূমি কর্মকর্তা ইমাম উদ্দিন বলেন, মামলার বিষয়ে গত ৫ মে রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় আসামিরাও সঙ্গে ছিলেন। এখন শুনেছি উভয়পক্ষকে থানায় বসার জন্য নোটিশ করেছে পুলিশ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'থানা কেন নোটিশ করেছে, ঘটনা তদন্ত করছে সে বিষয়ে আমার বলার কিছুই নেই। জাল কাগজে বিক্রি করা অর্পিত সম্পত্তি জেলা প্রশাসনের সেটা ভূমি সার্কেলের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাছাড়া হাইকোর্টের রিটের আদেশে এসব ভূমিদসু্য অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেইসসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। যা উপেক্ষিত।'

স্থানীয়দের ভাষ্য, এই ভূমিদসু্য অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় এবং আইনি সহয়তার কারণে বড়বাড়ী নাথা পাড়ার লোকজন রোষানলে পড়ে। তারা গত কয়েকদিন আগেও পাড়ার স্থানীয় এক ব্যক্তির গরু ও মুরগির খামারে রাতের আঁধারে বিষ প্রয়োগ করে। এতে খামারের শতাধিক গরু মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব গরু এখন স্থানীয় পশু চিকিসৎকদের অধীনে চিকিৎসাধীন আছে। এছাড়া স্থানীয় একটি পুকুরেও বিষয় প্রয়োগ করে। যেখানে অর্ধকোটি টাকার মাছ মরে ভেসে উঠে। যা স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এসব ঘটনায় থানায় একাধিক মামলা হলেও ভূমিদসু্য এই অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

স্থানীয়দের ধারণা, শান্তিপ্রিয় এই বড়বাড়ী নাথ পাড়ায় কোনো একটি অশুভ চক্র ভূমিদসু্য অপরাধ চক্র দিয়ে নানা রকম অপরাধ কর্মকান্ড ঘটিয়ে অশান্ত করে তোলার চেষ্টা করছে। এভাবে পাড়ার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের মাধ্যমে এই পাড়ার মূল্যবান জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। এই অশুভ চক্র থানা পুলিশের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে এসব কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে