সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কারণ খুঁজতে কমিটি

২২ বছরে ২৫ বার আগুনে ক্ষতি সাড়ে ৭১ একর বনভূমির

প্রকাশ | ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০

বাগেরহাট প্রতিনিধি
সুন্দরবনের পূর্বাংশে চাঁদপাই রেঞ্জের লতিফের ছিলা এলাকায় লাগা আগুন রোববার সন্ধ্যায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চল বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে। আগুন পুরোপুরি না নিভলেও তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে আগুনে এরই মধ্যে পুড়ে গেছে প্রায় ৪ একর বনাঞ্চল। এদিকে, অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে এ নিয়ে গত ২২ বছরে ২৫ বার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব আগুনের অধিকাংশই ঘটেছে শরণখোলা এবং চাঁদপাই রেঞ্জে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবার আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্ট পেশ করলেও অজানা কারণে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। জানা যায়, শনিবার দুপুরে আগুন লাগার পর সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও পানির উৎস দূরে থাকা এবং দুর্গম এলাকায় বনাঞ্চলের ঝুঁকি বিবেচনায় রাতে অগ্নিনির্বাপণের কাজ স্থগিত রাখে। তবে রোববার ভোরে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট, পুলিশ, বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা যৌথভাবে আগুন নেভানো শুরু করে। তাদের সহযোগিতায় যোগ দেয় কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি পৃথক দল। বিমানবাহিনী ওপর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটায়। রোববার ভোরে আগুন নেভানো শুরুর পর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা সাইদুল আলম চৌধুরী বলেন, 'সুন্দরবনের ভোলা নদী থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি নিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছে। আগুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জ্বলছে। এই আগুন নেভাতে সময় লাগবে।' নতুন কোনো এলাকায় যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য নজরদারি করা হচ্ছে জানিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নুরুল বলেন, 'অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে এসিএফ চাঁদপাইকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। স্টেশন কর্মকর্তা ধানসাগর ও স্টেশন কর্মকর্তা জিউধারাকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের ওই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগুন নির্বাপণের কাজ শেষ হলে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে।' ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মোরেলগঞ্জ স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা আবুল ফারুখ বলেন, 'আগুন নির্বাপণে আমাদের বিভিন্ন স্টেশনের ৫০ জন কর্মী এবং ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। পাম্প মেশিন, ফায়ার হোজ পাইপসহ সব মালামাল নিয়ে আসা হয়েছে। কাছের পানির উৎস ভোলা নদী থেকে আগুনের এলাকা প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে। সবকিছু স্থাপন করে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।' কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর ইবনে মহসীন বলেন, 'আগুন নির্বাপণের কাজে সহযোগিতার জন্য সকাল থেকে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে।' স্থানীয় বাসিন্দা ও চাঁদপাই রেঞ্জের পূর্ব আমোরবুনিয়া ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের (ভিসিএফ) সাধারণ সম্পাদক মহিদুল হাওলাদার বলেন, 'শনিবার রাতে আগুন আরও বাড়ছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত যতটুকু ছিল পাশের নতুন এলাকাও পুড়েছে। বেশ কিছু এলাকা একেবারে ছাই হইয়ে গেছে। বাতাসের গতিতে কিছু কিছু এলাকায় আগুন লম্বা হয়ে ছোটছে।' স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বনের ওই এলাকায় বন্য প্রাণীর চাপ বেশি। বাঘ, হরিণ, বানরসহ অনেক প্রাণীর বাস এখানে। বন থেকে লোকালয় কাছে হওয়ায় এবং সহজে বনে প্রবেশের সুযোগ থাকায় এখানে চোরা শিকারিদের বনে প্রবেশ সহজ। বনের ওই এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য এর আগে আগুন দেওয়ার অভিযোগও আছে। অন্যদিকে রোববার দুপুরে হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর থেকে আগুনের ওপর পানি ছিটায় বিমানবাহিনী। আগুনের উৎস দেখে দেখে তার ওপর পানি ফেলা হয়। রোববার দুপুরে মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম তারেক সুলতান বলেন, 'ভোলা নদী থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে আগুনের উৎস। নতুন এলাকায় যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিন দিক দিয়ে ফায়ার সার্ভিস পানি দিচ্ছে। এখন বনের মধ্যে বড় ধরনের আগুন নেই।' সন্ধ্যায় বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে বলেন, 'সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া জঙ্গলের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আসলে বনের আগুন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে ফায়ার লাইন কাটা। অর্থাৎ আগুনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে চারদিকে একটি শুরু নালা কাটা, যাতে করে আগুন একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায়। ভোর থেকে সেই কাজ শুরু হয়। আমরা ফায়ার লাইন কাটা শেষ করেছি। এরপর ভেতরে যেসব জায়গায় আগুন আছে, তা নেভানো হচ্ছে। এখন আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। যেহেতু এখানে অনেক শুকনা পাতা, তাই পানি দেওয়ার কাজ চলতে থাকবে।' সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগেছিল। এ নিয়ে গত ২২ বছরে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন ওই এলাকায় অন্তত ২৫ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দু'বার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দু'বার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমোরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দু'বার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার এবং ২০২১ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি ধানসাগর এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের ৩ মে শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়রা প্রায় ৩০ ঘণ্টার চেষ্টায় পরদিন ৪ মে নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু তার পরদিন ৫ মে সকালে আগের অগ্নিকান্ডের দক্ষিণ পাশে আবারও আগুন লাগে। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব থেকে যায় ফাইলবন্দি। সুপারিশগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ ও বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করা। সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এ নিয়ে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটল। বন বিভাগের হিসাবমতে, ২৪টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৩৩ টাকা। আগুনে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুন্ডলি, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক আচরণ ও দুষ্কৃতকারীদের দিয়ে বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরকেও দায়ী করে তদন্ত কমিটি। এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপিস্ননের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, 'ধারণা করা হয়, মৌয়ালদের (যারা বন থেকে মধু সংগ্রহ করেন) মশালের কারণে সুন্দরবনে আগুন লেগে থাকতে পারে। অথবা কারো বিড়ি সিগারেটের আগুন ফেলে রাখা থেকে আগুন ধরতে পারে। তুলনামূলক বনের যেসব এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকা অনেক উঁচু। গ্রীষ্ম মৌসুম চলায় অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়া ও শুকনো পাতা জমে যাওয়ার কারণে আগুন অনেকক্ষণ জ্বলে। আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি ও জনবল নেই বন বিভাগের। ফলে স্থানীয় ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে আগুন বহুদূর ছড়িয়ে যায়। এতে বনে ক্ষতি হয় বেশি।' আগুনের কবল থেকে সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রাখা সময়ের দাবি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।