মাইলফলক স্থাপনের পথে চট্টগ্রাম বন্দর

তিন কোটি তিন টাকায় ৫০১ একর জমি পেল বে-টার্মিনাল

প্রকাশ | ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
ব্যবসা-বাণিজ্যে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চট্টগ্রাম বন্দরকে সক্ষমতার চূড়ায় উঠতে হবে। যার জন্য চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গায় আউটার রিং রোডের পশ্চিমে বে-টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চট্টগ্রাম বন্দর। যাকে আমদানি-রপ্তানি সম্প্রসারণের মাইলফলক হিসেবে মনে করা হচ্ছে। আর সেই মাইলফলক স্থাপনের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই চট্টগ্রাম বন্দর। বহু জল্পনা-কল্পনা শেষে বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতীকী মূল্যে ৫০০ দশমিক ৭ একর সরকারি খাস জমি বরাদ্দ পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পের জন্য প্রতীকী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি তিন টাকা। রোববার (৫ মে) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) পান্না আকতার। তিনি বলেন, বে-টার্মিনালের জন্য ৫০০ একর সরকারি খাস জমি প্রতীকী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালে তিন মৌজায় এসব জমির জন্য নির্ধারিত এক কোটি এক টাকা করে তিন কোটি তিন টাকা পৃথক তিন চালানে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-ব্যবস্থাপক (এস্টেট) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বলেন, বে-টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য প্রতীকী মূল্যে ৫০০ একর জমি জেলা প্রশাসন থেকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সরকার নির্ধারিত মূল্য জমা দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে এসব মূল্য চালান মূলে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বে-টার্মিনাল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি হলে চট্টগ্রাম বন্দর একটা মাইলফলক স্থাপন করবে। এটিতে সবসময় ১২ মিটার ড্রাফট (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) এবং যে কোনো দৈর্ঘ্যের জাহাজ এখানে ভেড়ানো যাবে। জোয়ারের সময় আরও দুই-তিন মিটার ড্রাফট বাড়তে পারে। একই সঙ্গে ৩৫ থেকে ৫০টি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে বর্তমান পোর্টে যেসব জটিলতা রয়েছে, তা প্রায় নিরসন হয়ে যাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জট কমবে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যয় কমবে, গতি বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নগরের পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সাগরঘেঁষে বে-টার্মিনাল নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। প্রকল্পের জন্য মোট ৮৭০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে ৬৭ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে। আরও ৮০৩ একর ভূমি বরাদ্দ পেতে ২০১৪ সাল থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসন তাদের অধিগ্রহণ করা এই জমির মূল্য নির্ধারণ করে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু বন্দর ভূমির জন্য বিপুল টাকা ব্যয় না করে প্রতীকী মূলে সেটি পাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ নিয়ে মতৈক্য না হওয়ায় জেলা প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিল। প্রায় দশ বছর পর জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পান্না আক্তারের গত ৩০ এপ্রিল স্বাক্ষরিত তিনটি চিঠিতে নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় মোট ৫০১ একর জমি বন্দোবস্তের জন্য প্রতীকী হিসেবে এক কোটি এক টাকা করে মোট তিন কোটি তিন টাকা সেলামি মূল্য জমা দেওয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। অকৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, ১৯৯৫ অনুযায়ী সরকার শর্তসাপেক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের জন্য এ জমি দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে বলে চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়েছে। সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, সরকার ভূমি বরাদ্দের বিষয়ে আগেই সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। কিন্তু অধিগ্রহণের খরচ বাবদ জেলা প্রশাসনের দাবি করা অর্থ নিয়ে একটু জটিলতা ছিল। শেষ পর্যন্ত নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের মধ্যস্থতায় জেলা প্রশাসন প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দে সম্মত হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ৫০১ একর ভূমি বরাদ্দের জন্য তিনটি পৃথক ডিমান্ড নোট পাঠিয়েছেন। ভূমি বন্দোবস্ত বাবদ টাকা জমা দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী আরও ৩০২ একর ভূমি বরাদ্দের প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সচিব মো. ওমর ফারুক। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, আমরা ভূমি পেয়ে গেছি। মাস্টারপস্ন্যান চূড়ান্ত হয়েছে। দেশি-বিদেশি পরামর্শক এবং বিদেশি বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে এটা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বে-টার্মিনালে দেশের সবচেয়ে গভীর চ্যানেল হবে। এটার ড্রাফট হবে ১২-১৪ মিটার। সব নকশা চূড়ান্ত হয়েছে। সুখবর হচ্ছে এখানে তিনটি টার্মিনাল হওয়ার কথা ছিল। এখন চারটি টার্মিনাল হবে। প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বে-টার্মিনালে প্রাথমিকভাবে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে একটি ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল, একটি ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। তিনটি টার্মিনালের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার। মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ টার্মিনালে জেটি থাকবে ছয়টি। বাকি দুটি টার্মিনাল সিঙ্গাপুরে পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল ও আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। এজন্য প্রতিষ্ঠান দুটি ১৫০ কোটি ডলার করে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আবুধাবি পোর্টস আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ হতে পারে। এছাড়া নৌপথ তৈরিতে ৫৯ কোটি ডলার বিনিয়োগ পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইস্ট কোস্ট গ্রম্নপ ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগে তেল ও গ্যাসের টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত ট্যারিফে বন্দর চলছে। এখন জ্বালানির দাম বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের ট্যারিফ কম। আমরা প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। এটা জরুরি। বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, কোভিড অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতির প্রত্যাশিত গতি মন্থর করলেও চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে তেমন প্রভাব ফেলেনি। সর্বোচ্চ ২ দিনে জাহাজ লোড-আনলোড শেষ করে পরবর্তী গন্তব্যে ছেড়ে দিচ্ছি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে কনটেইনার হ্যান্ডলিং আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এবার ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে। রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় আমরা আমাদের জলসীমা নিরাপদ রেখেছি। চট্টগ্রাম বন্দর নিরাপদ। বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ এলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে জেনারেল কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ৯ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার টন। এ সময় জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩ হাজার ১টি। বিগত বছরে ৪৩ হাজার বর্গমিটার কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ২০ ফুটের ৭ হাজার কনটেইনার রাখার সুযোগ হয়েছে। ৪ হাজার ২৭৫ বর্গমিটারের কেমিক্যাল শেড নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষায় উভয় পাড়ে ২ হাজার ৮৫০ মিটার রিভেটমেন্ট কাজ সম্পন্ন হয়েছে।