বাংলাদেশে বিমান ভাড়া বাড়িয়েই চলছে বিদেশি এয়ারলাইন্স

'এই সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণে টিকিটের দাম যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে কমেছে টিকিট বিক্রির পরিমাণও'

প্রকাশ | ০১ মে ২০২৪, ০০:০০

বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশ থেকে অর্থ ছাড় করে নিজ দেশে নিতে না পারায় টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে চলেছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। বাংলাদেশে আটকে আছে তাদের পাওনা ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দ্রম্নত এই বকেয়া পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণ সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন আইএটিএ। গত ২৪ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি জানায়, শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের কাছেই আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলোর পাওনা আছে ৭২ কোটি ডলারের ওপরে। এর মধ্যে বাংলাদেশের কাছে পাওনা ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ অ্যাটাব বলছে, বাংলাদেশে ডলার সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিমান সংস্থাগুলোর বিল পরিশোধ করতে সংকটে পড়তে হচ্ছে। যে কারণে গত এক থেকে দেড় বছরে এই বকেয়ার পরিমাণ এতটা বেড়েছে। অ্যাটাব মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, 'এই সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণে টিকিটের দাম যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে কমেছে টিকিট বিক্রির পরিমাণও।' এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বকেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন তো হচ্ছেই, পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাংলাদেশে বিমান টিকিটের দাম বেড়েই চলছে। এ কারণে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ কিংবা টিকিট না কেটে দেশের বাইরে থেকে কম খরচে টিকিট কাটছে ও ভ্রমণ করছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদ-উল আলম বলেন, 'এই বকেয়ার কারণে গত বছরও আইএটিএ বাংলাদেশ-পাকিস্তান ছাড়াও আরও তিনটি দেশকে নোটিশ দিয়েছিল। গত এক বছরে সেই তিনটি দেশ এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যজনক এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।' বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (ক্যাব) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, 'দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টাকা আটকে গিয়েছিল। এখন আস্তে আস্তে করে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স এগুলো পাচ্ছে।' চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে বিবৃতি :গত বুধবার আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণ সংস্থা (আইএটিএ) তাদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে পাওনা পরিশোধের তাগিদ দেওয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাজারে বিমান সংস্থাগুলোর পাওনা আছে ৭২ কোটি ডলার। এই অর্থ না পাওয়ায় তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। এই অর্থের মধ্যে বাংলাদেশের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর পাকিস্তানের কাছে বকেয়া ৩৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। পাওনা পরিশোধের তাগিদ দেওয়া হয় ওই বিবৃতিতে। বিবৃতিতে এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে আইএটিএর ভাইস প্রেসিডেন্ট ফিলিপ গোহ বলেন, লিজ চুক্তি, খুচরা যন্ত্রাংশ, ওভারফ্লাইট ফি এবং জ্বালানির মতো ডলারনির্ভর খরচ মেটাতে বিভিন্ন দেশের কাছে এই পাওনা সময়মতো পরিশোধ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গোহ বিবৃতিতে বলেন, এই পাওনা পরিশোধে বিলম্ব দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন এবং তা বিমান সংস্থার জন্য ঝুঁকির হার বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদ-উল আলম বলেন, 'বকেয়া থাকা অন্য দেশগুলো যদি তাদের দেনা পরিশোধ করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশেরও উচিত ছিল সময়মতো পরিশোধ করা।' কেন এই সংকট? :বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রায় ৩০টি বিদেশি এয়ারলাইন্স কোম্পানি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এসব এয়ারলাইন্সগুলো ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন বা আইএটিএ'র মাধ্যমে তাদের পেমেন্টগুলো গ্রহণ করে থাকে। বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট বিক্রি করে আইএটিএ'র অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে এই টিকিট বিক্রির অর্থ ছাড় হয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক কামরুজ্জামান রনি বলেন, 'বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিট আমরা সেল করে আইএটিএ-কে দিয়ে দিচ্ছি। টাকাটা আইএটিএ'র অ্যাকাউন্টে আছে। কিন্তু আইএটিএ-কে এখান থেকে এই অর্থ নিতে হলে ডলারে নিতে হবে। এই ডলারটা বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ত ছাড় করছে না।' মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টিকিটের অর্থ ছাড়া না পাওয়ার কারণেই এই সংকট। অ্যাটাব মহাসচিব আরেফ বলেন, 'যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, সে কারণে এই টাকা ধীরে ধীরে অ্যাপ্রম্নভাল দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় অ্যাপ্রম্নভাল হওয়ার পরও সিডিউল ব্যাংকে হয়ত পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় কোম্পানিগুলোর এই টাকা পেতে অনেক দেরি হচ্ছে।' বাংলাদেশে বিদেশি এয়ারলাইন্সের রাজস্ব আটকে থাকার ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইএটিএ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার আটকে থাকার কথা জানায়। আর পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুনে রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২১ কোটি ডলার। এবার তা ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি এয়ারলাইন্সকে তাদের আয়ের একটি অংশ পাঠানোর সুযোগ দিচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে কম ভাড়ার টিকিট বিক্রি বন্ধ রেখেছে। বেড়েই চলছে টিকিটের দাম :বিশ্বের প্রায় ৩০০ এয়ারলাইন্সের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইএটিএ। এর মাধ্যমে আকাশপথে বিশ্বের ৮৩ শতাংশ পরিবহণ হয়। বিদেশি এয়ারলাইন্সের এই বিপুল পরিমাণ দেনা পরিশোধ না করায় এর বড় একটি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশ থেকে বিমানে ভ্রমণকারীদের ওপর। অ্যাটাব বলছে, বিদেশি প্রত্যেকটি এয়ারলাইন্স চায়, তাদের বিক্রীত টিকিটের অর্থ তাদের দেশে নিয়ে যেতে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে, ডলার সংকটের কারণে এক বছরের বেশি সময় এই অর্থ বাংলাদেশে আটকে থাকছে। অ্যাটাব মহাসচিব আরেফ বলেন, 'এই কোম্পানিগুলো কস্ট অব ফান্ড ক্যালকুলেশন করে যখন দেখছে টিকিট বিক্রির টাকা ঝুলে থাকার কারণে তাদের ক্ষতি হচ্ছে, তখন তারা বাংলাদেশে টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।' টিকিটের এই দাম বৃদ্ধির পার্থক্য আসলে কত? এমন প্রশ্নে অ্যাটাব উদাহরণ দিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার জন্য টিকিটের দাম এক লাখ টাকা হলে, সেই টিকিট কলকাতা থেকে কেউ কিনলে দাম পড়বে মাত্র ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো।' আরেফ বলেন, 'পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশ টিকিটের মূল্য ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। বকেয়াসহ বিভিন্ন কারণে যেহেতু ভাড়াটা বেড়ে যাচ্ছে, এটার একটি অ্যাফেক্ট বাংলাদেশের জনগণের ওপরও পড়ছে। কারণ, মানুষকে তখন বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হচ্ছে।' সংকট কাটাতে উদ্যোগ কী? গত দেড় বছর থেকে বাংলাদেশে ডলার সংকট বাড়তে থাকে। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে শুরু করায় শুরু হয় এই সংকট। এর আগে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে নির্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আয় পাঠাতে পারত। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। ফলে এই কোম্পানিগুলোকে চেয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে। একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, অন্যদিকে ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়েছে গত এক বছরে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ইদানীং অনেক ভ্রমণ বেড়েছে। এটা দেখে বিদেশি অনেক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে আসার আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু যখন তারা দেখছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সের কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে আটকে আছে তখন অনেক প্রতিষ্ঠান আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তিনি বলেন, 'অনেক এয়ারলাইন্স সচেতনভাবে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা তা আর বাড়াচ্ছে না। বরং ফ্লাইট কমিয়ে দিচ্ছে অনেকে। যখন সাপস্নাই কমে যাবে, তখন স্বাভাবিকভাবে প্রোডাক্টের দাম বাড়ে।' তিনি বলছেন, যত দ্রম্নত এয়ারলাইন্সগুলোকে তাদের প্রাপ্য অর্থ রেমিট করতে পারবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে, তত দেশের জন্য মঙ্গল। ইন্ড্রাস্ট্রির স্বার্থেই দ্রম্নত এটা করা দরকার। অ্যাটাব মহাসচিব আরেফ বলছেন, সিভিল এভিয়েশন, টু্যরিজম করপোরেশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। বাংলাদেশ ব্যাংককে আমরা বলেছি, এয়ারলাইন্সের টাকাটা যাতে দ্রম্নত অনুমোদন দেওয়া হয়। তাহলে তারা যাতে দ্রম্নত টাকা তাদের দেশে পাঠাতে পারে। এভাবে সমাধান না করলে অন্য কোনো ওয়েতে সমাধান নেই। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আস্তে আস্তে করে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে। আরেকটু অবস্থার উন্নতি হলেই সংকট কেটে যাবে।