শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

চট্টগ্রামে সিন্ডিকেটের কবলে পোলট্রি খাত

লোকসানে বন্ধ শত শত খামার
সনজীব নাথ ও ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
  ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
চট্টগ্রামে সিন্ডিকেটের কবলে পোলট্রি খাত

বাচ্চা সংকটের কারণে চট্টগ্রামে অস্থির হয়ে উঠেছে পোলট্রি খাত। বাচ্চা যা পাওয়া যাচ্ছে তাও অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া এ শিল্পের খাবারের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। বেড়েছে ওষুধের দামও। এতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার অনেক খামার। এসব কিছুর জন্য অসাধু করপোরেট সিন্ডিকেটের কারসাজিকে দায়ী করছেন খামারিরা।

খামারিদের অভিযোগ, পোলট্রি খাত এখন খামারিদের হাতে নেই। এটি করপোরেট কোম্পানির সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। মূলত হ্যাচারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে একদিন বয়সি মুরগির বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। একই সঙ্গে ডিমের দামও। ফলে বাজারে ডিম ও মুরগির দাম সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রিটন চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান বাজার মূল্যে একটি ডিমের খুচরা দাম পড়ে সাড়ে ১১ টাকা। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে যদি দ্বিগুণ খরচও ধরা হয় তা হলে মুরগির একদিন বয়সি একটি বাচ্চার দাম ২৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে একদিন বয়সি একটি বাচ্চা খামারে তুলতে হলে একজন খামারিকে গুনতে হচ্ছে ৯৫ থেকে ৯৭ টাকা। মূলত চাহিদার তুলনায় সংকট সৃষ্টি করে বাচ্চার দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা মুরগি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এতে লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক খামার।'

তিনি আরও বলেন, '২ হাজার ২০০ টাকার পোলট্রি ফিডের দাম হয়েছে এখন ৩ হাজার ৬০০ টাকা। মুরগির একদিন বয়সি একটি বাচ্চার দাম প্রায় ১০০ টাকা। মুরগি লালন পালনে যে খরচ বেড়েছে তাতে প্রতি কেজি মুরগি ৩০০ টাকা বিক্রি করার কথা।'

সে হিসেবে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। প্রতি ডজন ডিমও বিক্রি করা হচ্ছে ১২৫ টাকায়। তবে লাইলাতুল কদর থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হয়েছে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এরপরও পোলট্রি খাতে লোকসান ও ব্যবসা ছাড়ার গল্প শোনাচ্ছেন খামারিরা।

খামারিদের কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করে পাইকারি দামে দোকানদারের কাছে বিক্রি করেন হাটহাজারী উপজেলার ব্রোকার আমান উলস্নাহ। তিনি বলেন, এক সময় তিনি বিভিন্ন দোকানে দৈনিক ২ হাজারের বেশি মুরগি সরবরাহ করতেন। মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সংখ্যা এখন ৭০০ থেকে ৮০০-এর মধ্যে নেমে এসেছে। দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষ মুরগি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এ সংকটের জন্য তিনিও বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় গত মাস ছয় মাসে লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত খামার। লাখ লাখ টাকায় বানানো শেড, মূল্যবান জিনিসপত্র পড়ে আছে। কাজ হারিয়ে এ খাতের অনেকে খামারি এখন বেকার।'

চট্টগ্রামের হাটহাজারী

উপজেলার মদুনাঘাট এলাকার পোলট্রি খামারি মনির হোসেন বলেন, '২০০৪ সাল থেকে পোলট্রির ব্যবসা করছি। সম্প্রতি দিন-রাত পরিশ্রম আর একক বিনিয়োগের পরও লোকসান গুণছি। বাচ্চা সংকটের কারণে পাঁচ মাস ধরে লোকসানে পড়ে একে একে বন্ধ করে দিতে হয়েছে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা তিনটি খামার। বন্ধ হওয়ার পথে আরও একটি খামার।'

সম্প্রতি খামারের দুরবস্থা আর এ শিল্পে খামারিদের দুর্দিনের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমি লোকসানে আছি। তাই আমি আমার খামারের ১০ বছরের পুরনো কর্মচারীদের চাকরিচু্যত করতে বাধ্য হয়েছি। কোম্পানিগুলো নিজস্ব শেডে বাচ্চা দিতেই ব্যস্ত। তারা তাদের উৎপাদিত বাচ্চার অর্ধেক নিজস্ব শেডে নিয়ে যায়। বাকি অর্ধেকের বেশির ভাগ কন্ট্রাক্ট ফার্মে দেওয়া হয়। ডিলাররা বাকি বাচ্চা থেকে অল্প কিছু পান। ডিলাররা বাচ্চা না পেয়ে লোকসানে পড়ছেন। উৎপাদনে না থাকলেও খামারের খরচ কিন্তু থেমে নেই। আয় না থাকায় অনেকে ব্যাংক ঋণ দিতে পারছেন না।'

কেবল মনির হোসেন নয়, এমন খামারির সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। অনেক খামারি লোকসানে মুরগির খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে সংসারের সবকিছু বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছেন। অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন।

সীতাকুন্ডের ছকিনা পোলট্রির স্বত্বাধিকারী মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, 'নব্বইয়ের দশক থেকে আমি পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ছোট-বড় ৯টি লেয়ার ও ৩টি ব্রয়লার পোলট্রি খামার রয়েছে আমার। খামার থেকে মাসে ২ লাখ ডিম বাজারে সরবরাহ করা হয়। নিজস্ব পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন কারখানাও রয়েছে। এক সময়ে দাপুটে খামারি হলেও এখন দুর্দিন যাচ্ছে। পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে ৩০ হাজার মুরগি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন তার ৩টি খামার। আরও কয়েকটি খামারেও বাচ্চা সরবরাহ করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। কেননা মাংসের উপযোগী হওয়ায় সেসব ফার্মের মুরগিও বিক্রি করে দিতে হবে দ্রম্নতই। এতে নতুন করে বাচ্চা ওঠানো না গেলে বন্ধ হতে পারে বাকি ফার্মগুলোও।'

মেজবাহ উদ্দিন বলেন, '২৮ বছর ধরে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে আমি জড়িত। কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। এক সময় কোম্পানিগুলো শুধু বাচ্চা উৎপাদন করলেও খাদ্য বাজারজাত করত না। তখন আমরা খামরিরা নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করতাম। কিন্তু কোম্পানিগুলো এখন খাদ্যের পাশাপাশি নিজস্ব শেড গড়ে তুলেছে। আর কন্ট্রাক্ট ফার্মিং সিস্টেমের মাধ্যমে কেবল নির্দিষ্ট খামারিকে বাচ্চা দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদন কমের অজুহাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খামারিদের জিম্মি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা বাচ্চা, খাদ্য, মাংস ও ডিম সবকিছুরই বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে শেডগুলো নির্মাণ করেছে তাদের এখন পথে বসতে হচ্ছে। অথচ আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি কন্ট্রাক্ট ফার্মে ঠিকই বাচ্চা দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা ব্যাংক ঋণ, বিদু্যৎ বিল, কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মাসে মাসে বহন করতে হচ্ছে বিনা আয়ে। ব্যবসায়ে এই স্থবিরতার কারণে আমরা কেবল পিছিয়েই যাচ্ছি না এ শিল্প থেকে হারিয়েও যাচ্ছি।'

এ সময় তিনি প্যারাগন অ্যাগ্রোর বিক্রয় প্রতিনিধি সারোয়ারুল ইসলামকে বাচ্চা পেতে কল করেন। কিন্তু তিনি তাকে সাফ জানিয়ে দেন বাচ্চা কোম্পানির নিজস্ব ফার্মেই উঠবে। তাই বাচ্চা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। পরে ডায়মন্ড অ্যাগ্রো নামে আরও একটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি শরীফুলকে বাচ্চার জন্য বেশ কয়েকবার কল করেন নাছির উদ্দিন। কিন্তু বাচ্চা পাওয়া যায়নি।

নাছির উদ্দিন নামে এক খামারি জানান, 'চট্টগ্রামে কাজী ফার্মস, আফতাব, সিপি, প্যারাগনসহ কয়েকটি কোম্পানি খামারিদের কাছে বাচ্চা বিক্রি করে। আবার নিজেরাও চুক্তিভিত্তিক মুরগি উৎপাদন করে। খামারিকে নিঃস্ব করে তারা বাজার দখল করে অর্থ তুলে নেয়। ফিড, বাচ্চা এবং খামারিদের শ্রম মিলে বাজারে এখন মুরগির যে দাম তাকে ন্যায্য দাম বলা যায় না।'

তিনি বলেন, 'একসময় কোম্পানিগুলো বাচ্চা বিক্রির জন্য খামারিদের কাছে এসে বসে থাকত। আর এখন প্রায় সময় বাচ্চার জন্য কল করেও পাওয়া যায় না। কোম্পানিগুলো নিজস্ব ফার্মে বাচ্চা তুলে যেমন ইচ্ছা তেমন দামে বিক্রয় করে। ফলে বাজারে এখন মুরগির দাম চড়া।'

সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। অনেক চেষ্টা করেও চাকরি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সীতাকুন্ডের শেখপাড়ার গ্রামের বাড়িতে চালু করেন ৬ হাজার মুরগি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ব্রয়লার মুরগির ফার্ম। বাচ্চা সংকট, খাদ্যের অতিরিক্ত দামের কারণে বাধ্য হয়ে লোকসানের মুখে ফার্ম তিনটি গুটিয়ে নেন।

সাইফুল ইসলাম বলেন, 'প্রতি বস্তা খাদ্যে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ও বাচ্চায় ২ থেকে ৩ টাকা এবং ওষুধের দামও বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। যেসব খামারির দৈনিক ১৫ হাজার বা মাসে ৪ লাখ ৫০ হাজার বাচ্চা প্রয়োজন সেখানে কিনতে পারছেন গড়ে দৈনিক মাত্র ১ হাজার যা মাসে ৩০ হাজার। বর্তমানে শত শত খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।'

একই কথা বলেন, সীতাকুন্ডের সিপি বাংলাদেশের ডিলার আমজাদ হোসেনও।

এ বিষয়ে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রভিটার জেনারেল ম্যানেজার ফজলুর রহমান জানান, 'গত কয়েক দিন ধরে মুরগির একদিন বয়সি বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। তা ডিলার এবং সাব-ডিলার পর্যায়ে গিয়ে হয়তো আরও ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়তে পারে। মূলত বাচ্চার সংকট রয়েছে। অপরদিকে চাহিদা বেশি। তাই বর্তমানে একদিন বয়সি বাচ্চার দাম একটু বেশি। ভোক্তা অধিকার যে রেট নির্ধারণ করে দিয়েছিল মুরগি সে দামে বিক্রি হচ্ছে না। কাঁচামাল চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে।'

বাংলাদেশ ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও নাহার অ্যাগ্রো গ্রম্নপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, 'বিভিন্ন ধরনের বাচ্চার দাম বিভিন্ন। ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম প্রতিটি ৮০ টাকা। তবে ডিলাররা বেশি দাম নিলে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কিছুই করার থাকে না।'

তবে সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'ব্রিডার ফার্মগুলোকে এক সময় মুরগির বাচ্চা ধ্বংস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ ওই সময় মুরগির বাচ্চার কোনো ক্রেতা ছিল না। অনেকেই প্যারেন্ট স্টক বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন চাহিদা বেড়ে গেলেও হঠাৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।'

রকিবুর রহমান টুটুল বলেন, 'বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা বাড়তি হলেও লেয়ার (ব্রাউন) ৩০ টাকা, লেয়ার (সাদা) ৩০ টাকা এবং কক মুরগির প্রতিটি বাচ্চা ১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগির দাম বেড়ে প্রতিকেজি ৩৮০ টাকায় বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। অথচ এ মুরগির দাম বাড়ার কথা নয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে