ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশু প্রীতি উরাংয়ের মৃতু্যর ঘটনাটি 'হত্যাকান্ড' মনে করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রম্নত বিচারের দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানায় সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে 'নিজেরা করি'র সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট খুশী কবির বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের একটা মূল্য আছে। একজন অতি শিক্ষিত, দায়িত্ববান ব্যক্তি, তার বাড়িতে এটা যদি ঘটে, এর মানে প্রতিটি বাড়িতে অহরহ এটা ঘটতে থাকে, এটা আপনারা জানেন। আমরা এটা আর সহ্য করব না।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা এবং কল্যাণের জন্য বারবার সরকারের কাছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি ও অনুরোধ জনানো হলেও বাস্তবে আমরা এর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। সাম্প্রতিক সময় গৃহকর্মীদের নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা আমাদের এর প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
গত ৬ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই শিশুটির অস্বাভাবিক মৃতু্য ঘটেছে। ঘটনার সময় সৈয়দ আশফাকুল হক ইংরেজি দৈনিক 'দ্য ডেইলি স্টার' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ৪ এপ্রিল তিনি চাকরিচু্যত হন।
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃতু্যকে ঘিরে তাকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত, পক্ষপাতহীন ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দ্রম্নত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই আমরা। ওই বাসায় আরও কয়েকজন শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেসব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আমরা সোচ্চার।
এ সময় সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন তারা। এগুলো হলো : ১. প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃতু্য বা হত্যার সুষ্ঠু স্বাধীন নিরপেক্ষ, পক্ষপাতহীন, প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. প্রীতি উরাংয়ের মৃতু্যকে অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড বিবেচনা করা হলে এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হালকা করা হবে। এই মামলা অবিলম্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় এনে নারী শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনালে বিচার করতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কিংবা প্রয়োজনে উচ্চ বিচার বিভাগীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।
৩. প্রীতির পরিবারকে যথোপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। সেই সঙ্গে তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৪. আশফাকুল হকের বাসায় নির্যাতিত অন্য যে শিশুটি বেঁচে আছে, তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও শিক্ষারব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫. শিশুটির শরীরের বিশেষ ক্ষতটি পরীক্ষা করে প্রকৃত ঘটনার তদন্ত করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি প্রক্রিয়ায় দোষীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। ৬. সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় তিনজন শিশু গৃহকর্মী ছিল। তারা ৭, ৮ এবং ১১ বছর বয়সে কাজে যোগ দেয়। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন মানুষ শিশু। শ্রম আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী, কোনো শিশুকে কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যায় না। সৈয়দ আশফাকুল হক কিংবা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর কোনো নির্যাতনের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে. সেগুলোর বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি আমরা। সেই সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
৭. যে দারোয়ানরা বাড়ির মালিকের ইশারায় বা নির্দেশে প্রীতিকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে দেয়নি, তাদেরও নিরপেক্ষ বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই সঙ্গে ডেইলি স্টারের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি মিন্টু দেশোয়ারা এবং প্রীতির মামা ফুলসাই ওঁরাংকে তদন্তের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। ৮. চা বাগান থেকে আনা শিশুদের পাচার করা এবং যৌনদাস করার জন্য কোনো চক্র কাজ করেছে কিনা, সেটিও আলাদাভাবে তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি।
৯. শিশুশ্রম-বিষয়ক নীতিমালাকে আইনে পরিণত করার জোর দাবি করছি। শ্রমে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ১৪ বছরের পরিবর্তে ১৬ বছর করার দাবি করছি সরকারের কাছে। সেই সঙ্গে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালায় গৃহে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ১৪ বছরের পরিবর্তে ১৬ বছর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
১০. ২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, শ্রম মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিয়ে গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সারাদেশে মনিটরিং সেল গঠনের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা অবিলম্বে কার্যকরের জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে গৃহশ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।