চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলায় এবারের শিরোপা জিতেছেন নবাগত শরীফ। কুমিলস্নার হোমনা উপজেলার বাসিন্দা ফরিদ স্থানীয়দের কাছে 'বাঘা শরীফ' নামে পরিচিত। জব্বারের বলীখেলায় প্রথমবার অংশ নিয়েই তিনি বাজিমাত করেছেন। রানার আপও হয়েছেন একই জেলার রাশেদ।
বৃহস্পতিবার বিকালে লালদীঘি মাঠে বলীখেলার ১১৫তম আসরে ফাইনালে মুখোমুখি হন দুইজন। প্রায় ১১ মিনিট খেলার পর রাশেদ পরাজয় মেনে নিয়ে শরীফের হাত তুলে ধরেন; যার কারণে রেফারি শরীফকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
বাঘা শরীফের বাড়ি কুমিলস্না জেলার হোমনা থানার মহিপুর গ্রামে। বাঘা শরীফ ও মোহাম্মদ রাশেদ দুজনই চারবারের (২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২৩) চ্যাম্পিয়ন কুমিলস্নার শাহজালাল বলীর শিষ্য। দুই শিষ্যকে সুযোগ করে দিতে এবারের আসরে অংশ নেননি শাহজালাল বলী।
আর গতবারের চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল ও রানাস আপ জীবন বলী এবারের প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করলেও অংশ নেননি। এবারের বলীখেলায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন খাগড়াছড়ির সৃজন চাকমা।
দুপুরে বলীখেলা শুরুর আগে থেকেই নগরীর লালদীঘি ময়দানে হাজারো দর্শক জড়ো হন। ঐতিহ্যবাহী এ খেলা দেখতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মাঠ। ঢোল-বাজনার তালে তালে আর করতালিতে তারা সমর্থন জোগাতে থাকেন বলীদের।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলীখেলা উদ্বোধনের পর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে খেলা শুরু হয়। কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নানা বয়সি ৮৪ জন বলী এ বছরের ১১৫তম আসরে অংশ নেন।
এর আগে, ১৯০৯ সালে স্থানীয় বদর পাতি এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলা চালু করেন। এরপর থেকে প্রতি বাংলা বছরের ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে এ খেলার আয়োজন করা হয়। ব্যবসায়ী আবদুল জব্বারের নামানুসারে খেলাটির নাম রাখা হয় জব্বারের বলীখেলা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বলীখেলার স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এনএইচটি স্পোর্টস কমপেস্নক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর।
বৈশাখী মেলায় দেশীয় পণ্যের সমাহার
এদিকে, চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলাকে কেন্দ্র করে বুধবার থেকে শুরু হওয়া বৈশাখী মেলা জমে উঠেছে। নগরীর আন্দরকিলস্না মোড় থেকে হাজারি গলি হয়ে টেরীবাজার, লালদীঘি পাড়, কে সি দে রোড, সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে অন্তত এক হাজার দোকান বসেছে। প্রতিটি দোকান সেজেছে দেশীয় পণ্যে। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে এসেছেন মেলায়। কমতি নেই ক্রেতা-দর্শনার্থীদেরও। ক্রেতা-বিক্রেতা মিলিয়ে জমজমাট তিন দিনের এই বৈশাখী মেলা।
বৃহস্পতিবার ছিল মেলার দ্বিতীয় দিন। এদিন বিকালে ছিল জব্বারের বলীখেলা। খেলা দেখতে ছুটে আসেন চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। যারা মেলা থেকে কিনছেন নানা গৃহস্থালি পণ্য, কম লাভে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও।
পণ্যের মধ্যে মাটির তৈরি ছোট-বড় ব্যাংক, ফুলদানি, কাপ-পিরিচ, জগ-গস্নাস, হাতপাখা ও ধর্মীয় নানা স্মারক বিক্রি হচ্ছে বেশি। মুড়ি-মুড়কি, বাঁশি, শিশুদের খেলনা, টমটম গাড়ি, নারীদের ইমিটেশনের গহনা, শীতলপাটি, ফুল ও ফলের চারা, বাঁশের শলার তৈরি মাছ ধরার চাই (ফাঁদ), ডালা, কুলা, দা-বঁটি, পস্নাস্টিকের ফুলসহ বাহারি সব জিনিস কিনছে মানুষ। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের রকমারি শোপিসের প্রতি আগ্রহ বেশি তরুণ-তরুণীদের।
চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিদরাতুল সাদিয়া লিসা ও তার তিন বান্ধবী বৃহস্পতিবার দুপুরে আসেন বৈশাখী মেলায়। লিসা বলেন, গরমে ঘরে থাকা দায়। তাই মেলায় ঘুরতে এসেছি। সেখানেও প্রচন্ড রোদ। ঘেমে গেছি সবাই। এরপরও আমি একটি ফুলের টব ও একটি মাটির তৈরি ব্যাংক কিনেছি। পণ্যগুলো অন্য যে কোনো দোকানের চেয়ে দাম কম।
তার বান্ধবী শারমিন আক্তার তোয়াহা বলেন, আমি হাতের চুরি, কানের দোল ও কিছু শোপিছের জিনিস কিনেছি। মার্কেটের দামের চেয়ে আনেক কম দামে পেয়েছি। তবে গরমের কারণে মেলায় ঘুরাঘুরি করতে কষ্ট লাগছে বলে জানান তিনি।
দুই সন্তানকে সঙ্গে করে মেলায় এসেছিলেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সিডিএ স্কুলশিক্ষিকা রাহেলা আক্তার। তিনি বলেন, মেয়েদের বৈশাখী মেলা দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি। তবে ছোটবেলায় বৈশাখী মেলার যে আমেজ আমরা পেতাম, এখন আর তা নেই। এরপরও এমন মেলাগুলো কিছুটা হলেও বৈশাখের আমেজ দেয়।
লালদীঘির পেট্রোল পাম্প এলাকায় ঢাকা, শাহবাগ, সাভার, বরিশাল, কুমিলস্না থেকে মৃৎশিল্প সামগ্রী নিয়ে এসেছেন তরুণ উদ্যোক্তা দীপু। তিনি জানান, শুক্রবার শেষ হচ্ছে তিন দিনের এই মেলা। সময় কম হওয়ায় আমরা কেনাদামেই পণ্য বিক্রি করে দিচ্ছি। নয়ত গাড়ি ভাড়া খরচ করে আবার ফেরত নিয়ে যেতে হবে এসব পণ্য। এতে লাভের চেয়ে ভোগান্তি বাড়বে।
পেট্রোল পাম্প ছাড়াও মাটির জিনিস পাওয়া যাচ্ছে সিনেমা প্যালেস থেকে সোনালী ব্যাংক আসার পথেও। বড় বড় মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, কলসিসহ আকর্ষণীয় সব জিনিস মিলছে এখানে।
হরিপদ দাশ নামে এক বিক্রেতা বলেন, তিনি গাজীপুর থেকে এসেছেন মাটি তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে। দেশের নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে মেলা করায় তার পেশা। ৩০ বছর ধরে তিনি চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় দোকান করেন।
মৃৎশিল্প সামগ্রী কিনতে এসেছেন সুলতানা জাকারিয়া। তিনি বলেন, মাটির তৈরি জিনিসে ঘর সাজিয়ে আত্মীয়স্বজনদের চমক দেখাতে চাই। বলীখেলা ছাড়া চট্টগ্রামে এত সুন্দর সুন্দর মৃৎশিল্প সামগ্রী পাওয়া যায় না। এছাড়া মার্কেটের দোকানের চেয়ে মেলায় জিনিসপত্রের দাম অনেক কম।
নরসিংদী জেলা থেকে বেতের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে এসেছেন খোকন। তিনি বলেন, আমি বাড়িতে তৈরি ঢালা, কুলা, পাখা, ঝাড়ুসহ হরেক রকম জিনিসপত্র এনেছি। আশা করি, আশানুরূপ বিক্রি হবে।
দিনাজপুর থেকে শিমুল তুলা বিক্রি করতে এসেছেন জামাল হোসেন ভুঁইয়া। তিনি বলেন, আমরা দিনাজপুরে নিজস্ব বাগানে তুলা চাষ করি। সেই তুলা তুলে নানা প্রক্রিয়ার পর মেলায় আনি। কেজি ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করছি শিমুল তুলা।
লালদীঘির উত্তর-পূর্ব কোণে বসেছে দেশি-বিদেশি ফুল ফলের চারার স্টল। আম, ডালিম, কমলা, সফেদা, মরিচসহ বাহারি ফুল, পাতা শোভা পাচ্ছে চারাগাছগুলোতে। বিক্রেতারা জানালেন, ছোট ছোট চারা বিক্রি হচ্ছে বেশি। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা মেলার সময় আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারি বলেন, জব্বারের বলীখেলা ঘিরে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থেকে আন্দরকিলস্না পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় বৈশাখী মেলা বসে প্রতিবছর।
করোনার কারণে দুই বছর হয়নি ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা। এবার ২৪ এপ্রিল থেকে বৈশাখী মেলা শুরু হয়। যেখান থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ এক বছরের গৃহস্থালি টুকিটাকি সংগ্রহ করেছেন। বলা হয়ে থাকে সুঁই থেকে ফুলশয্যার খাটও মেলে জব্বারের বলীখেলায়।
তিনি বলেন, শুক্রবার তিন দিনের এই বৈশাখী মেলা শেষ হবে। ভোরের মধ্যে সড়কের আশপাশ থেকে সব দোকানপাট উঠে যাবে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকালে জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। জব্বারের বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে বলীখেলা কমিটি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ফলে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা ছাড়াই মেলা ও খেলা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান জহর লাল হাজারি।