চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হবে। তবে আজ বুধবার থেকে মিলছে তিনদিনের বৈশাখী মেলা। খেলা ও মেলার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে।
মঙ্গলবার এ তথ্য জানান আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি স্থানীয় আন্দরকিলস্না ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী। তিনি বলেন, প্রতি বছরের মতো বাংলা বর্ষের ১২ বৈশাখ অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল লালদীঘির মাঠে বলীখেলা হবে। বাঁশ ও বালি দিয়ে মাঠে বলীখেলার মঞ্চ (রিং) তৈরির কাজ চলছে। তবে বলীখেলার আগের দিন ২৪ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত লালদীঘির মাঠ ঘিরে বসছে বৈশাখী মেলা।
তিনি বলেন, 'মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বলীখেলায় অংশগ্রহণকারীদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে। খেলায় যারা অংশ নেবেন, তাদের জন্য এবার আমরা পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। সার্বিক আয়োজনে সহযোগিতা দিচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।'
জহর লাল হাজারী বলেন, 'প্রতি বছর এ সময়টাতে তাপপ্রবাহ থাকে। এবারও তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করব, আপনারা শরবত পানের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। চিকিৎসকরাও বলছেন, যততত্র বিক্রি হওয়া শরবত যেন পান করা না হয়। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মেলায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হবে।'
জহর লাল হাজারী আরও বলেন, চসিকের মেয়র দেশের বাইরে যাচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীও রাষ্ট্রীয় কাজে দেশের বাইরে থাকছেন। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানকে বলা হয়েছে। সিএমপি কমিশনারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খেলা ও মেলায় অংশগ্রহণ করবেন।
এর আগে গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বলীদের জার্সি এবং চ্যাম্পিয়ন ও রানার-আপ ট্রফি উন্মোচন করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
নগরীর লালদীঘির পাড়ে চসিক পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানে মেয়র ঘোষণা দেন, আগামী প্রজন্ম যেন বলীখেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে, সে জন্য কুস্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
অনুষ্ঠানে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এ বলীখেলা আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। বলীখেলাকে ঘিরে তিনদিনের মেলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আসেন। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সবার কাছে অনুরোধ, নতুন প্রজন্ম যেন আমাদের এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখে সে জন্য আমাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে।
মেয়র বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে বলীখেলায় অংশ নিচ্ছেন, কুস্তিগীর, রেফারি ও আয়োজক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি করা হোক। এবারের বলীখেলার পরেই এ বিষয়ে আয়োজকরা উদ্যোগ নেবেন। একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে। জায়গা আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেব। এ জন্য যা যা সহযোগিতা দরকার, সিটি করপোরেশন ও আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে করা হবে।
কমিটির সহ-সভাপতি সাংবাদিক চৌধুরী ফরিদ বলেন, এটি ঐতিহাসিক বলীখেলা। এবার হবে ১১৫তম আসর। সারা বিশ্বে এ খেলা তুলে ধরতে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। বলীখেলা টু্যরিজম বোর্ডের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বলীদের প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। বলীখেলার পাশাপাশি তিনদিন ধরে মেলা চলবে। এবারের আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে এনএইচটি হোল্ডিংস লিমিটেড। মেয়র একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এবারের আয়োজন শেষেই যেন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করা হবে।
বলীখেলার এবারের পৃষ্ঠপোষক এনএইচটি হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর বলেন, ছোট থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন খেলা ও মেলা হবে। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি বলীখেলা। চট্টগ্রামের হারানো ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। এ লক্ষ্যে বলীখেলায় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছি আমরা।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, ২৫ এপ্রিল আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ১৯০৯ সালে এ বলীখেলার প্রচলন করেছিলেন আবদুল জব্বার সওদাগর। করোনার কারণে গত দুই বছর বলীখেলা হয়নি। এ খেলা সফল করার জন্য সবার সহযোগিতা চাই।
উলেস্নখ্য, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর কুস্তির প্রবর্তন করেছিলেন, যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলীখেলা নামে পরিচিত। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি।
সূচনার ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলীখেলা। বলীখেলার একদিন আগে-পরে তিনদিন ধরে লালদীঘির পাড়সহ আশপাশের এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বসে মেলা। এ মেলায় গৃহস্থালি পণ্য থেকে শুরু করে নানা পণ্যের পসরা বসে।
এদিকে জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে যান চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ২৪ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত লালদীঘি অভিমুখী সব ধরনের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আগামী ২৫ এপ্রিল নগরীর লালদীঘির পাড় মাঠে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মেলায় দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পণ্য বিক্রেতারা তাদের পণ্যদ্রব্যাদি নিয়ে আসবে এবং ক্রেতাসাধারণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সমাগম হবে। বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চলাকালীন ক্রেতা-বিক্রেতাসহ আগত লোকজনের সমাগমের কারণে লালদীঘি মাঠ সংলগ্ন আন্দরকিলস্না মোড় (জামে মসজিদের সামনে), পুরনো টেলিগ্রাফ রোড, বোস ব্রাদার্স মোড় (পুলিশ পস্নাজার সামনে), রাইফেল ক্লাব, কোতোয়ালি মোড় (সিডিএ গেট), আমানত শাহ মাজার রোডের মুখ এবং টেরিবাজার ফুলের দোকান (তিন রাস্তার মুখ) রোড বস্নক স্থাপনের মাধ্যমে ডাইভারশন প্রদান করা হবে। ফলে উক্ত সময়ে লালদীঘি অভিমুখে সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন কোতোয়ালি মোড় হয়ে ফিরিঙ্গীবাজার মেরিন ড্রাইভ রোড ব্যবহার করে চাক্তাই ও রাজখালী হয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে যাতায়াত করবে।
লালদীঘি মাঠে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈশাখী মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এই নির্দেশনা অনুসরণের জন্য যানবাহন চালক ও যাত্রীদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।