অতিরিক্ত তাপ :বিশ্বে বছরে ১৮,৯৭০ শ্রমজীবীর মৃতু্য
প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত তাপের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃতু্য হচ্ছে।
সোমবার প্রকাশিত 'এনশিউরিং সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাট ওয়ার্ক ইন আ চেঞ্জিং ক্লাইমেট' (জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা) শিরোনামের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, বিশ্বের সব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। ৩৪০ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ২৪০ কোটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন। অর্থাৎ, বৈশ্বিক শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন।
প্রতিবেদন বলা হয়, ২০০০ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি কর্মী অতিরিক্ত তাপের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন। তাপমাত্রা ও শ্রমশক্তি বাড়ার কারণে এ সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে অতিরিক্ত তাপ, আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন, চরম আবহাওয়া, কর্মক্ষেত্রে বায়ুদূষণ, পরজীবী-ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসবাহিত রোগ এবং অ্যাগ্রোকেমিক্যাল (কৃষি খাতে ব্যবহার করা রাসায়নিক) এ ছয় ক্ষেত্রে কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়, অতিরিক্ত তাপের পাশাপাশি বন্যা, খরার মতো চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে হতাশা, উদ্বেগ, সব বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক আঘাতজনিত দুশ্চিন্তা ও মাদকাসক্তি বাড়ছে। দুর্যোগের মধ্যে জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, জেলে, কৃষি ও নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যেও নাজুক মানসিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা যা আছে তা যথেষ্ট নয়। অনেক দেশ তাপ থেকে সৃষ্ট রোগকে 'পেশাগত রোগ' বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঝুঁকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা। ঝুঁকি থাকলেও আর্থিক কারণে তারা অতিরিক্ত গরমের মধ্যেও কাজ করেন।
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইএলওর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (ওএসএইচ) দলের প্রধান মানাল আজি বলেন, এটা এখন স্পষ্ট যে জলবায়ু পরিবর্তন কর্মীদের উলেস্নখযোগ্য হারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই ঝুঁকিগুলোর বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় নীতি গ্রহণ ও কার্যকলাপবিষয়ক যা যা করা হয় তার মধ্যে অবশ্যই পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত গরমজনিত প্রায় সোয়া দুই কোটি 'পেশাগত দুর্ঘটনায়' ২০ লাখের বেশি মানুষকে নানা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। কৃষি, নির্মাণ, পরিবহণ খাতের মতো বাইরে কাজ করা কর্মীরা অতিরিক্ত গরমের কারণে মৃতু্য ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে পড়ছেন। তারা হিটস্ট্রেস, হিটস্ট্রোক, হিটক্র্যাম্পস,র্ যাশ, ত্বকে ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসজনিত অসুস্থতা, কিডনির রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা জটিলতায় পড়ছেন।
প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের আরও নানা কারণে কর্মক্ষেত্রসংক্রান্ত মৃতু্যর তথ্য উলেস্নখ করা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ১৬০ কোটি মানুষ আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশনের ঝুঁকিতে পড়ে। এ কারণে ত্বক ক্যানসারে বছরে মৃতু্য হয় ১৮ হাজার ৯৬০ জনের। বাইরে বা রাস্তাঘাটে কাজ করা ১৬০ কোটি মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হয়। এর ফলে ৮ লাখ ৬০ হাজার কর্মীর মৃতু্য হয়। ৮৭ কোটির বেশি মানুষ কৃষিকাজ করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন কীটনাশকের সংস্পর্শে আসেন। বছরে ৩ লাখের বেশি কর্মী কীটনাশকের বিষাক্ততার কারণে মারা যান। পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসবাহিত রোগের সংস্পর্শে এসে (ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ সৃষ্টিকারী) বছরে ১৫ হাজার কর্মী মারা যান। চরম আবহাওয়ায় ভূমির পরিবর্তন, খাদ্যসংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাবের মধ্যে কাজের নিশ্চয়তা কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে হতাশা শুরু হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, লাওসসহ অনেক অঞ্চলে গত বছরের এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রা দেখা গেছে। এ ধরনের আবহাওয়াকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ উলেস্নখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
প্রতিবেদনে অভিবাসীকর্মীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কায়িক শ্রম বেশি করতে হয় বলে তারাও ঝুঁকিতে থাকেন। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায়, সে সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন না।
বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, গত বছর ৮ লাখের বেশি কর্মী শুধু মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বছরের বড় সময় ধরে উচ্চ তাপপ্রবাহ থাকে। বিশেষ করে জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। গতকাল দুপুরের দিকে ঢাকার তুলনায় মক্কা, দোহা ও দুবাইয়ে ৫ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কম ছিল। এ সময় ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আইএলও বাংলাদেশের যোগাযোগ ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাথেরিন এমজেন্ডি বলেন, বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এই সময়ে বাইরে যাদের কাজ করতে হয় তারা তাপজনিত অসুস্থতার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ক্যারিবীয় অঞ্চলে চরম আবহাওয়া দুশ্চিন্তা, হতাশা ও সব বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতার বোঝা বাড়াচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির প্রতিটি খাতে পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংলাপ আয়োজনসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার।