ন্যায্য ক্ষতিপূরণ মেলেনি বিচারে অগ্রগতি সামান্য
বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের ৫৫% কর্মহীন দুদকের দুটি মামলার নিষ্পত্তি ৫৯৪ সাক্ষীর ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে এখনো প্রশ্ন সাভারে দুই দিনের কর্মসূচি শুরু
প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বিশ্বের ভয়াবহতম 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্র্যাজেডি' রানা পস্নাজা ধসের ১১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর অদূরে সাভারে রানা পস্নাজার আটতলা ওই বাণিজ্যিক ভবনটি ধসে পড়ে। ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। আইএলও'র তথ্য অনুযায়ী, এতে নিহত হন ১১৩২ জন, যার বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক। আহত অবস্থায় উদ্ধার হন আরও প্রায় আড়াই হাজার। যাদের অনেককেই আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। এছাড়া বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের প্রায় ৫৫ শতাংশ এখনো কোনো কাজ পাননি। তাদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ করছেন ভিক্ষাবৃত্তি। দীর্ঘদিনেও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া সত্ত্বেও হয়নি আহতদের পুনর্বাসন। এদিকে, এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে দুটি নিষ্পত্তি হলেও বাকি মামলার বিচারে অগ্রগতি সামান্যই। ফলে শ্রমিকরা কবে ন্যায়বিচার পাবেন তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। রানা পস্নাজা ধসে হতাহতের ঘটনায় সব মিলিয়ে ১৪ মামলা দায়ের হওয়ার কথা জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এর মধ্যে রয়েছে, অবহেলাজনিত মৃতু্যর অভিযোগে পুলিশের হত্যা মামলা, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের করা মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা দুটি মামলা। ওই দিকে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতা বা সরকারি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে ব্যর্থতাসহ বেশ কটি অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ১১ মামলা শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে দুদকের দায়ের করা মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হত্যা মামলার কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আপিল করায় বার বার পিছিয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ। তবে আপিল খারিজ হওয়ায় মামলার বিচারে গতি পেয়েছে। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি 'অবহেলাজনিত মৃতু্যর অভিযোগে পুলিশের হত্যা মামলা' ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ওই দিন তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ নিয়ে মামলার ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আইনজীবীরা আরও জানান, হত্যা ও ইমারত আইনের মামলা দুটি ২০১৩ সালে দায়ের হলেও বিচারের জন্য প্রস্তুত হয় তিন বছর পর। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলায় ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে আছেন, ৩১ জন জামিনে আছেন এবং সাতজন পলাতক, মারা গেছেন দুইজন। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের মামলার চার্জশিট দাখিল হয়। সিআইডি তদন্ত শেষে ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তাতে বলা হয়, ঘটনার আগের দিন ভবনটির তৃতীয়তলার পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছিল। বাণিজ্যিক ওই ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। যেখানে বৈদু্যতিক জেনারেটরসহ ভারী যন্ত্রপাতি ছিল। সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়, মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ওইদিন সকাল ৯টায় হঠাৎ বিদু্যৎ চলে গেলে একসঙ্গে কয়েকটি জেনারেটর চালু করা হয়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবনটি ধসে পড়ে। দুদকের নিষ্পত্তি হওয়া দুটি মামলার মধ্যে রয়েছে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলা এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে মামলা। নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট প্রধান আসামি সোহেল রানার তিন বছর কারাদন্ডের আদেশ দেন ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। ওই মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। আর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। সেইসাথে তার প্রায় সাত কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত। ১১ বছরেও মামলার বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অধিকারকর্মীরা। তাদের দাবি- বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে। তারা আশা করেন, রাষ্ট্রপক্ষ রানা পস্নাজার মামলার বিচার দ্রম্নত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। ৫৫ শতাংশ শ্রমিক কর্মহীন :বেসু[রকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ এখনো কর্মহীন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল 'রানা পস্নাজা দুর্ঘটনা : ট্র্যাজেডি থেকে ট্রান্সফরমেশন' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সমীক্ষার ওই ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সেখানে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ গত পাঁচ থেকে আট বছর ধরে কর্মহীন। আর সাড়ে পাঁচ শতাংশ শ্রমিক গত তিন থেকে চার বছর ধরে কর্মহীন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের শারীরিক অবস্থা নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষায় তুলে ধরা হয় বরিশালের নারী শিলা বেগমের কথা। তিনি একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় একমাত্র মেয়ে নীপাকে নিয়ে সাভারে এসে চাকরি শুরু করেন। যোগ দেন রানা পস্নাজার ছয়তলার ইথার টেক্স কারখানায় অপারেটর পদে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল তার সব আশা শেষ হয়ে যায় রানা পস্নাজা ধসের সঙ্গে সঙ্গে। তিনি জানান, ধসে পড়া ভবনের বিমের নিচে তিনি চাপা পড়েন। প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। প্রথম দিকে সরকারিভাবে কিছু টাকা পেলেও সেই টাকায় তার চিকিৎসাও ঠিকমতো করতে পারছেন না। অভাবে সন্তানের লেখাপড়াও বন্ধের পথে। কোনোরকম দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন তিনি। শিলা বেগম বলেন, 'মেরুদন্ডে সমস্যা, হাতে সমস্যার পর এখন পেটে টিউমার হয়েছে। সর্বক্ষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দ্রম্নত অপারেশন করা দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে করতে পারছি না। মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি আমি ওইদিন মরে গেলেই ভালো হতো।' শিলা বেগমের মতো অনেকেই এখনো রানা পস্নাজা ধসের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তারা শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তবে অঙ্গহানি হওয়া শ্রমিকরা ভালো নেই। কেউবা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছেন। অনেকেই ভিক্ষা বৃত্তি করে চালাচ্ছেন জীবন-সংসার। আইএলও'র কনভেনশন মেনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অভিযোগ, গত ১১ বছরে আহতদের পুনর্বাসনে ও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সরকার বা বিজিএমইএ কারও পক্ষ থেকেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলোকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। তবে বিজিএমইএ বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন বাবদ সব ধরনের সহায়তাই দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, রানা পস্নাজা ধসের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে সরকারি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি রানা পস্নাজায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে কিছু সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশে আহত শ্রমিকদের আঘাতের ধরন ও ক্ষতির প্রকৃতি অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ভাগে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিক, যারা মূলত মেরুদন্ডে আঘাত পেয়েছেন কিংবা দুই বা ততোধিক অঙ্গহানি হয়েছে। তাদের ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা হয়। দ্বিতীয় ভাগে মূলত এক হাত বা এক পা হারানো শ্রমিকরা ছিলেন। যাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেককে সাড়ে সাত লাখ টাকা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তৃতীয় ভাগে ছিলেন দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন এমন শ্রমিক। তাদের জন্য জনপ্রতি সাড়ে চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা হয়। চতুর্থ ভাগে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আহত ব্যক্তিরা পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিনা খরচে সার্বিক চিকিৎসা দেওয়া এবং সরকারি হাসপাতালে আজীবন বিনা পয়সায় কৃত্রিম অঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়। আর আইএলও'র বিধান নিয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আলোচনা ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু সরকারি কমিটির ওইসব সুপারিশের কোনোটিই মানেনি বিজিএমইএ। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী সবাইকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি রানা পস্নাজায় হতাহত শ্রমিকদের আইএলও'র কনভেনশন মেনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সহ-সভাপতি জলি তালুকদার বলেন, 'একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হতাহত হলে তাকে দুই-তিন লাখ টাকা দেওয়া উপহাসমূলক হয়ে যায়। আইএলও কনভেনশন ক্ষতিপূরণের যে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা চাই সরকার ও গার্মেন্টস মালিকরা সেটা মেনে চলুক।' রানা পস্নাজায় আহত শ্রমিক সাভারের হাফিজা বলেন, 'রানা পস্নাজা ধসে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। নাম মাত্র অনুদান ছাড়া ক্ষতিপূরণ পাইনি। বিচারও পাইনি। আমাদের কোনো দাবিই পূরণ হয়নি। আমরা ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই।' প্রসঙ্গত, দেশের সংশোধিত শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিককে এক থেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে রানা পস্নাজা ধসের প্রভাবে ওই সময় বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন ২০১৩ সালে রানা পস্নাজা ধসের পর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর জোট 'অ্যাকোর্ড' ও 'অ্যালায়েন্স' দেশের সরকার ও বিজিএমইএ-বিকেএমইএ'র সহযোগিতায় তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার কথা বলে, বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে কারখানাগুলোর বিল্ডিং শক্তিশালীকরণে প্রোডাকশনের কাজ করে, তারা কারখানাগুলোর অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাও পর্যবেক্ষণ করে। চুক্তি অনুযায়ী তাদের কাজ শেষে তারা ফিরে যায়। কিন্তু এ ঘটনার ১১ বছরেও কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, ভবনগুলো ও কারখানার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে এখনো শ্রমিকদের গায়ে হাত তোলা হয়, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। বিশেষত নারী শ্রমিকদের ঠুনকো অজুহাতে যখন তখন ছাঁটাই করা হয়, ভিত্তিহীন অভিযোগে মিথ্যা মামলা করা হয়, কথায় কথায় হাজিরা কেটে দেওয়া হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করানো হয়, সাপ্তাহিক ছুটি নিয়মিত দেওয়া হয় না, জোরপূর্বক ওভারটাইম করানো হয়, নানা অজুহাতে ৩০-৪০ ঘণ্টা ওভারটাইম কেটে নেওয়া হয়, অসুস্থ হয়ে ছুটির আবেদন করলেও ছুটি দেওয়া হয় না ইত্যাদি। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, 'এ অবস্থাকে কোনো অর্থেই নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে বলা চলে না। এছাড়া অধিকাংশ শ্রমিক অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বস্তিতে বসবাস করেন। দেশের জন্য ৮২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন যারা, সেই শ্রমিকদের এই পাশবিক জীবন কোনো সুস্থ মানুষ মেনে নিতে পারার কথা নয়।' রানা পস্নাজার আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের পুনর্বাসনের দাবি থাকলেও তা পূরণ করা হয়নি। শ্রমিক পক্ষের, বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকদের একটা দাবি, একটা সেন্টিমেন্ট ছিল- রানা পস্নাজার জায়গাটিতে শ্রমিকদের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ ও একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে দিক সরকার এবং ২৪ এপ্রিলকে শোক দিবস ঘোষণা করা হোক। কিন্তু এসব কিছুই করা হয়নি- উলেস্নখ করেন তিনি। আমি কী পেলাম : হাত হারানো সাদ্দাম ধসেপড়া রানা পস্নাজার পাশের ভবনে একটি বেসরকারি অফিসে সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। রানা পস্নাজা ধসে পড়ে পাশের ওই ভবনের ওপর। নিচতলার অফিসে আটকা পড়েন তিনি। ঘটনার দিন তাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তার ডান হাত কেটে ফেলা হয়। সাদ্দাম হোসেন এখন 'রানা পস্নাজা সার্ভাইভারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক'। তিনি বলেন, 'আমি কী পেলাম? আমাকে দেওয়া হলো না চাকরি বা ক্ষতিপূরণ।' ৩০ শিশুর ঠিকানা 'অরকা হোমস' রানা পস্নাজা ধসে প্রাণ বা অঙ্গ হারানো পরিবারের সদস্যদের ১০ বছর ধরে সেবা দিয়ে আসছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার একটি বেসরকারি সংগঠন 'অরকা হোমস'। এর পাশেই রয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'হোসেনপুর মুসলিম একাডেমি'। সেখানেই এই শিশুরা লেখাপড়া করে আসছে। স্কুলটিতে পেস্ন গ্রম্নপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। জানা যায়, রানা পস্নাজায় হতাহত পরিবারের সেসব সন্তান এখানে রয়েছে তাদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় খরচ অরকা হোমস থেকে বহন করা হচ্ছে। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা আসে।
দুই দিনের কর্মসূচি শুরু
এদিকে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণের দাবিতে ‘রানা প্লাজা হত্যাকাÐের ১১ বছর : হাজারো প্রাণ ও স্বপ্নের গল্প’ নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সাভারে রানা প্লাজার সামনে সকাল ৯টায় দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন হয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে।
প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত শ্রমিক জেসমিন। জেসমিন রানা প্লাজা ভবনের ধ্বংসস্তূপে দুই দিন আটকে থাকার পর উদ্ধার হয়েছিলেন।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন আহত জেসমিন, নিহত শ্রমিক আঁখি আক্তারের মা নাসিমা আক্তার, নিহত ফজলে রাব্বীর মা রাহেলা আক্তার, নিহত শাহীদার মা তাহেরা বেগম এবং গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন, গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার শাখার সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন।
প্রদর্শনীতে মোট চারজন আলোকচিত্রীর কাজ এবং পোশাক শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে সাতজন আঁকিয়ের চিত্রকর্ম এবং জীবিত থাকা অবস্থায় স্টুডিওতে ২০ জন শ্রমিকের তোলা ছবি স্থান পেয়েছে। আলোকচিত্রীদের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, আলোকচিত্রী এন্ড্রু বিরাজ, রাহুল তালুকদার ও শুভ্রকান্তি দাসের ছবি প্রদর্শিত হয়।
এছাড়া নিহত ও আহত পরিবারের কাছ থেকে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সংগৃহীত ছবি স্থান পায়। বেশির ভাগ সংগৃহীত ছবি শ্রমিকরা স্টুডিওতে গিয়ে বা শখ করে তুলেছিলেন। চারজন আলোকচিত্রীর ছবি এবং শ্রমিকের সন্তানদের আঁকা ছবি যেমন নির্মম, সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে, তেমনি শ্রমিকদের নিজেদের স্টুডিওতে গিয়ে তোলা ছবি যেন তাদের স্বপ্নের কথা বলে। নিহত শাহেদুল তার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে স্টুডিওতে ছবি তোলেন, ব্যাকড্রপে উড়োজাহাজ। হয়তো শাহিদুলের স্বপ্ন ছিল দেশের বাইরে যাওয়ার!
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে এসব শ্রমিকের প্রাণ ও স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেছে। রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো যাতে আর কারও অকালে মরতে না হয়, সে জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে দিয়েছেন আয়োজকরা।
আহত শ্রমিক জেসমিন বলেন, ‘এমনভাবে দুই দিন আটকা ছিলাম, বাঁচার কোনো আশা ছিল না। একজন অচেনা মানুষ আমাকে আগলে রেখে বাঁচিয়েছিলেন। তখন কে পুরুষ, কে নারী, কে হিন্দু, কে মুসলমান ভাবার সুযোগ ছিল না। বাঁচার চরম ইচ্ছা এবং সন্তানকে দেখার ইচ্ছা ছাড়া কোনো কিছু মাথায় আসেনি।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘১১ বছরেও ১১৭৫ জন প্রাণ হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়নি। কারখানার ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া অন্যান্য মালিক, সরকারি কর্মকর্তারা জামিনে জেলের বাইরে আছেন। সোহেল রানাও গত বছর জামিন পায়। পরবর্তীতে তার জামিন উচ্চ আদালত স্থগিত করে।’
বিচারের এই ধীরগতি সরকার ও রাষ্ট্রের মালিকপক্ষ এবং দোষীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের এবং তাদের বাঁচিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টারই সামিল বলে অভিহিত করেন অন্যান্য বক্তারা।
‘ক্ষতিপূরণ কোনো ভিক্ষা নয়, এটি শ্রমিক ও নাগরিকের আইনি অধিকার’- এই অধিকার রক্ষায় এক হওয়ার আহŸান জানান তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী কর্মসূচিতে রানা প্লাজার সামনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও প্রতিবাদী র্যালি অনুষ্ঠিত হবে আজ।