দুর্ভোগে জেলে-ট্রলার মালিকরা
বেড়েছে জেলিফিশ, সাগরে মাছের চরম আকাল
প্রকাশ | ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় মাছের আকাল চলছে। এ অবস্থায় জেলেরা সাগরে মাছ শিকারে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জেলে ও ট্রলার মালিকরা।
সমুদ্রবিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, সামুদ্রিক কচ্ছপের বিচরণ ও সংখ্যা কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে জেলিফিশ বস্নুম বা উচ্চ প্রজনন হারের ঘটনা ঘটছে।
এদিকে চট্টগ্রামের সব হাটবাজারে চলছে মাছের আকাল। ফলে মাছের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বঙ্গোপসাগরে তেমন মাছ ধরা না পড়ায় এই সংকট শুরু হয়েছে।
জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে এই সংকট শুরু হলেও এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে চট্টগ্রামের ফিশিং ট্রলারগুলো সাগরে না গিয়ে এখন কর্ণফুলী নদীতে অলস সময় কাটাচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন জেলেরা। চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ফিশিং ট্রলার মালিকরা।
এদিকে ব্যবসা ছেড়ে বেকার সময় কাটাচ্ছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন হাটবাজারের অধিকাংশ মাছ ব্যবসায়ী। দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে কমেছে মাছের ক্রেতাও।
শুক্রবার দুপুরে
চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটে মাছ কিনতে আসা ক্রেতা সাইফুদ্দিন জানান, বাজারে আগে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যেত, এখন কিছু পোয়া মাছ ছাড়া সামুদ্রিক অন্য কোনো মাছ নেই। এর মধ্যে ছোট জাতের পোয়া মাছ সর্বনিম্ন কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি আকারের পোয়া কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে পাঁচশ থেকে ৬০০ টাকার ওপরে।
এছাড়া স্টোরকৃত ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের অল্প ইলিশ মিলছে বাজারে। যেগুলো কেজি ২ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে স্টোরকৃত লাক্ষ্মা মাছ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা কেজিতে। কোরাল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে। একইসঙ্গে খাল ও পুকুরের মাছও বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে। এর মধ্যে রুই মাছের দাম সবচেয়ে বেশি। এক কেজি ওজনের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকার উপরে। দুই কেজি ওজনের দাম ৬০০ টাকার ওপওে, যা রোজার আগেও বিক্রি হয়েছে অর্ধেকেরও কম মূল্যে।
আশ্চর্যের বিষয় যে, ছোট ছোট কাচকি মছের কেজিও বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৮০০ টাকা দামে। খালে ধরা পড়া চিংড়ির পোনাও বিক্রি হচ্ছে এই দামে। মাছের এই অস্বাভাবিক দামের কারণে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মাছের বাজার থেকে।
বিষয়টি স্বীকার করে বহদ্দারহাটের পুরনো মাছ ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান বলেন, বাজারে মাছ না আসায় রোজার আগে থেকে অনেক মাছ ব্যবসায়ী বেকার সময় কাটাচ্ছেন। ঈদে তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যদের গায়ে নতুন জামা কাপড় উঠেনি। বাজারে এই পরিস্থিতি এখনো চলছে। সামনে ২০ মে থেকে আসছে সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় মাছ ক্রেতা-বিক্রেতা, জেলে ও ফিশিং ট্রলারের মালিকরা চোখে অন্ধকার দেখছেন।
ফিশিং ট্রলার মালিকরা জানান, একটি জাহাজ জেলেদের নিয়ে নদীতে অলস বসে থাকলে মাসে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এ কারণে বাধ্য হয়ে কোম্পানি একাধিক ফিশিং ট্রলার কোম্পানি গুটিয়ে ফেলার চিন্তা করছে।
বস্নু সাউথ ফিশিং কোম্পানির পরিচালক সাজিদ বিন সোলায়মান বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে সাগরের অবস্থা খারাপ। এখন সাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাচ্ছে সব জেলিফিশ। তাই মাছ ধরা বন্ধ করে জেলেরা কর্ণফুলীতে অবস্থান করছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কোম্পানির দু'টি ফিশিং জাহাজ আছে। যেগুলো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। দুই জাহাজে নাবিক-জেলেসহ প্রায় ৮০ জন কর্মী রয়েছেন। অফিসে আছেন আরও ১০ জন। এই ৯০ জনের বেতন-ভাতা চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ কারণে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধের চিন্তা করছে।
এফভি নাজমঈনের ক্যাপ্টেন কবির হোসাইন বলেন, জেলে, জ্বালানি ও রসদ নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়াকে আমরা বলি ভয়েজ। প্রতিটি ভয়েজে ২০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজ অন্তত ১০০ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করতে পারে। এখন জেলিফিশ বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০ টন মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ট্রলার মালিকদের বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান হচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমরা দুই মাস ধরে তীরে অবস্থান করছি। এই অবস্থা কবে নাগাদ শেষ হবে বলতে পারছি না।
ট্রলার মালিক এস এম আল মামুন মিয়া বলেন, আমি দীর্ঘ সময় ধরে মাছ ধরার ব্যবসায় যুক্ত। চলতি মৌসুমের মতো বিপর্যকর সংকটে আর পড়িনি। লোকসান গুনতে গুনতে চোখে অন্ধকার দেখছি।
জেলে ও ট্রলার মালিকরা জানান, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে ১২৮ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার এলাকা হিসেবে ফিশিং গ্রাউন্ড নামক স্থানে যান জেলেরা। সেখানকার ৪০ থেকে ৬০ মিটারের বেশি গভীরতায় মাছ আহরণের প্রতিযোগিতা চলে কাঠ ও ইস্পাতের তৈরি ৫০ থেকে ৪০০ টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজের। কিন্তু গভীর সমুদ্রের সব জায়গায় প্রতিটি জালে উঠে আসছে ১০ থেকে ২০ টন জেলিফিশ। এর মধ্যে মাছ ১০০ কেজিও থাকছে না। সাগর থেকে যেন উধাও হয়ে গেছে ইলিশ, রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্ণাসহ প্রায় সব প্রজাতির মাছ।
আনোয়ারা উপজেলার জেলে এনামুল হক বলেন, গত ৩০ মার্চ ট্রলারের মালিক সাড়ে তিন লাখ টাকার রসদ কিনে আমাদের সাগরে পাঠিয়েছিলেন। সাগরে গিয়ে তিন দিন ছিলাম। কয়েক স্থানে জাল ফেলেছিলাম। কিন্তু জেলিফিশে ভরা সেই জাল। তাই বাধ্য হয়ে ফিরে আসি। ফিরে আসার পর মাত্র তিন হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে।
চট্টগ্রামের মেরিন ফিশারিজের পরিদর্শক এস এম সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে একবার সাগরে জেলিফিশের আধিক্য বেড়েছিল। সেই সময়ও জেলেদের জাল মাছশূন্য ছিল। এবারও একই কারণে জেলেদের জাল মাছশূন্য হয়ে পড়ে। বিষয়টি প্রাকৃতিক। নির্দিষ্ট সময় পরপর সাগরে এই ধরনের সংকট তৈরি হয়।
তিনি জানান, চট্টগ্রামে ২২১টি ফিশিং জাহাজ আছে। আর কাঠের তৈরি ট্রলার আছে ২৯ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগ ফিশিং যান এখন অলস সময় পার করছে। সমুদ্রে কেন জেলিফিশ বেড়েছে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, সাগরের পানিতে লবণাক্ত বৃদ্ধি, পানির তাপমাত্রার তারতম্যসহ নানা কারণে জেলিফিশের আধিক্য বাড়তে পারে। কচ্ছপের উপস্থিতি কমে যাওয়াও কারণ হতে পারে। তবে বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশের আধিক্য বেশি হওয়ার কারণ জানতে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি। এটা এখন বেশি জরুরি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন বলেন, মাছের প্রজননের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। আবার লবণাক্ততা বাড়ছে, তারতম্য হচ্ছে তাপমাত্রার। উন্নয়ন যজ্ঞের কারণে ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব কারণে বলা যায়, সাগরে মাছ কমছে। সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণীর সংখ্যাও বাড়ছে। এসব জানার জন্য সমন্বিত গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। গবেষণার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
উলেস্নখ্য, দেশে বর্তমানে মাছের চাহিদা বছরে প্রায় ৪৫ লাখ টন। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৭ লাখ টন। চলতি মৌসুমে সামুদ্রিক মাছ আহরণে বড় ধরনের ধাক্কা লাগায় চট্টগ্রামের বাজারে সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে আগামী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। ফলে চলতি মৌসুমে জেলেরা আবার সাগরে গিয়ে মাছ ধরতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।