দেশে নতুন এক আতঙ্ক নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বজ্রপাত। তথ্য বলছে, বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ২৬৫ জনেরও বেশি মানুষের মৃতু্য হয়। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মাঠে থাকা কৃষক, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়। অর্থাৎ বজ্রপাতে মাঠে-ঘাটে থাকা মানুষেরই বেশি মৃতু্য হয়। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃতু্য হয়েছে ৩৪০৭ জনের। এর মধ্যে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা যান ৩৪০ জন। ফলে স্বাভাবিকভাবে চলতি বছরেও বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। চলতি এপ্রিলে ইতোমধ্যে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ২১ জন। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাঙামাটির লংদুতে কালবৈশাখী ঝড়ের সময় বজ্রপাতে এক কিশোরীর মৃতু্য হয়েছে। এর আগে ১৬ এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যান চার জেলার ছয়জন। এর মধ্যে মাদারীপুরের শিবচর ও সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে দুজন করে এবং নরসিংদীর রায়পুরা ও ঢাকার ধামরাইয়ে একজন করে। আর ৭ এপ্রিল একদিনে নয় জেলায় মারা যান ১৪ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএফের) তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃতু্যই হয় বাংলাদেশে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু বজ্রপাত প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। আর প্রকল্পের নামে অর্থের অপচয় হলেও বজ্রপাতে মৃতু্য ঠেকানো যাচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের দুর্যোগ পরিস্থিতি বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষ রিপোর্টিয়ারের প্রতিবেদনে। ২০২৩ সালে মে মাসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে মৃতু্যর সংখ্যা তুলনামূলক কমে এসেছে। কিন্তু অতি উষ্ণতা ও বজ্রপাতের মতো নতুন ধরনের দুর্যোগে মৃতু্য ও বিপদ বাড়ছে।
বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান। তিনি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'বজ্রপাত বেশি হয় হাওর অধু্যষিত জেলাগুলোতে। সেখানে মৃতু্যও বেশি হয়। প্রাক মৌসুম যেমন মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় হাওড় অঞ্চলে। জেলাগুলো হলো- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। আর পুরো মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। মৌসুমের পর অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। শীতকালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত হয়।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়ও একই কাজে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২৩১ কোটি টাকা। ওদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) একটি প্রকল্পে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একাংশ দিয়ে দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় বজ্রনিরোধক দন্ড বসাচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ২০১৭ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় এ প্রকল্পটি ভেস্তে যায়। দেখা যায়, তালগাছের চারা কোথাও মরে যায়, আবার কোথাও চারা না লাগিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষাও হয়নি। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তালগাছ লাগানোর কার্যক্রমটি বাতিল হয়েছে। একটি তালগাছ বড় হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ বছর। এত সময় ধরে অপেক্ষার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ১৩২১ কোটি টাকার সাম্প্রতিক যে প্রকল্প নিয়েছে, তার আওতায় দেশের ১৫টি জেলায় ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক দন্ড বসানো ও ৩ হাজার ৩৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দন্ড বসাতে ব্যয় হবে ৭৩২ কোটি টাকা আর আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে ৪০৫ কোটি টাকা খরচ হবে। বাকি টাকা প্রকল্পের অন্যান্য কাজের জন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান চলতি বছরের ১১ ফেব্রম্নয়ারি জাতীয় সংসদে বজ্রনিরোধক দন্ড বসানোর কথা উলেস্নখ করে জানান, গত এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মৃতু্যর সংখ্যা বেড়েছে। এমন মৃতু্য রোধকল্পে প্রকল্প গ্রহণ
করা হয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, 'দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি রোধে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ' শিরোনামের প্রকল্পটি গত বছরের জুন মাসে প্রথমবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাব ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়। পরে একই বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকল্পটি আবারও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে বাস্তবায়িত হবে এ প্রকল্প।
এদিকে ২০১৮ সালে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আটটি স্থানে 'লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর' বসানোর উদ্যোগ নেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, বজ্রপাতের ১০ থেকে ৩০ মিনিট আগে সংকেত দেওয়া। কিন্তু জনবলের অভাবে সেন্সরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও সেন্সর বন্ধ আছে। কোথাও সংযোগের, কোথাও বিদু্যতের, কোথাও ইন্টারনেটের সমস্যার কারণে এসব সেন্সর থেকে তথ্য পাওয়া যায় না।
বজ্রপাতে যেহেতু কৃষকদের বেশি মৃতু্য হচ্ছে, এ কারণে 'হাওড়াঞ্চলে কৃষকদের জীবন সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন' নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালে নেওয়া ২৩১ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় হাওড়াঞ্চলের সাত জেলার ৫৮ উপজেলায় ১০০ থেকে ১২০ বর্গমিটার ব্যাসার্ধের ১৬টি 'আর্লি স্টিমারহ ইমিটার (ইএসই)' নামের বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হবে। পাশাপাশি 'আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সলু্যশন' সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ, ভয়েস ও খুদে বার্তার মাধ্যমে স্থানীয়দের সতর্কবার্তা দেওয়া হবে। কিন্তু কৃষকদের কাছে এমন প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্র না থাকায় এর সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় আছে।
অথচ একই প্রকল্প ২০১৭ সাল থেকে বাস্তবায়ন করে আলোর মুখ দেখেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। একই ধরনের প্রকল্প কৃষি মন্ত্রণালয় ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করছে। এটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
একইভাবে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগ 'রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপশন অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি রিডাকশন (রিভার)' নামক প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের অধীন দেশের এক হাজার ৪০০টি স্থানে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপন করার কথা। এ প্রকল্পে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য বলছে, প্রকল্পটি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ দুটি প্রকল্প আমাদের সঙ্গে দ্বৈততা সৃষ্টি করেছে। কারণ, দুর্যোগের আগাম সতর্কতা, দুর্যোগ থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং পুনর্বাসনের সব কাজ দুর্যোগ মন্ত্রণালয় করে থাকে। অথচ দুটি মন্ত্রণালয় ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই প্রকল্প দুটি শুরু করেছে। ফলে একই উদ্দেশ্যে নেওয়া ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান এনডিসি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'বজ্রপাতে মানুষের মৃতু্য যাতে কম হয় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে, সব প্রকল্প এক জায়গা থেকে হলে বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হতো।'
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার মতো এলাকায় বজ্রনিরোধক দন্ড বসিয়ে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য পরীক্ষামূলক একটি ছোট প্রকল্প নেওয়া যায়। স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া সেটার সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বজ্রনিরোধক দন্ডের তামার তার চুরি যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। নেপালে প্রাণহানি কমাতে বজ্রনিরোধক দন্ড বসানো হয়েছে। প্রথম দিকে ব্যাপক সমস্যা হয়েছিল। পরে তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের যুক্ত করে সফলতা পায়।
বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করা এসএসটিএফের গবেষণা সেলের প্রধান আবদুল আলীম বলেন, 'বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়া এবং গ্রামাঞ্চলে গাছ কেটে ফেলার কারণে মূলত বজ্রপাত বেড়েছে। খোলা মাঠ বা হাওরে তো কোনো গাছ থাকে না। থাকলেও তা কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে মাঠে বা খোলা জায়গায় থাকা কৃষকদের মৃতু্য হচ্ছে বেশি। একইভাবে গবাদি পশুরও মৃতু্য হচ্ছে।'
তার পরামর্শ হলো, 'আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে বা ঝড়-বৃষ্টি শুরুর সংকেত পাওয়া গেলে মানুষকে এমন কোনো স্থাপনায় আশ্রয় নিতে হবে যা বিদু্যৎ কুপরিবাহী। কোনোভাবেই গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কারণ গাছ বিদু্যৎ পরিবাহী। গাছের নিচে আশ্রয় নিলে গাছের বিদু্যৎ মানুষকে আক্রান্ত করবে।'