গ্রীষ্মে বিদু্যতের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বেড়েছে আমদানি নির্ভরতা। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে এর হার। বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী গড়ে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানি করছে সরকার। সে হিসাবে মোট বিদু্যতের প্রায় ১২ শতাংশ আমদানি করা হচ্ছে। যা আরও বাড়তে পারে। বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর বাড়তি উৎপাদন ব্যয় আমদানিকে উৎসাহিত করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিপিডিবি'র উৎপাদন বিভাগের কর্মকর্তারা যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে দেশের বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে বিপিডিবির কিলোওয়াট প্রতি গড় ব্যয় হয়েছিল ১৪ টাকা ৬২ পয়সা এবং ভাড়া আর ভাড়ায় চালিত কেন্দ্র থেকে ব্যয় হয়েছিল ১২ টাকা ৩৫ পয়সা। এর বিপরীতে ভারত থেকে বিদু্যৎ আমদানিতে ব্যয় কিলোওয়াট প্রতি ৮ টাকা ৭৭ পয়সা। অর্থাৎ আমদানি ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ বেশি খরচ হয় দেশে বিদু্যৎ উৎপাদনে।
এদিকে দেশের বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা এ বছর ৩০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে বিদু্যৎ বিভাগ। এছাড়াও বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে চলতি মাসে বিদু্যতের গড় চাহিদা দিনে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদন ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। বাকিটা করা হচ্ছে আমদানি।
বিদু্যৎ আমদানি বাড়ানোর ফলে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যেখানে গত অর্থবছরে এ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।
বিদু্যৎ খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্ধিত বিদু্যতের চাহিদা পূরণে আপাতত আমদানিকেই বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে মোট ৯ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদু্যৎ আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে আদানি পাওয়ার পস্ন্যান্টসহ ভারতের তিনটি বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে দিনে ১৬শ' থেকে ১৮শ' মেগাওয়াট বিদু্যৎ কেনা হচ্ছে, যা আরও বাড়ানো হতে পারে। এর বাইরে নেপাল ও ভুটান থেকে আরও বিদু্যৎ আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছর দেশীয় উৎপাদন না বাড়িয়ে আমদানি করেই বিদু্যৎ সরবরাহ করা হতে পারে।
বিপিডিবির উৎপাদন বিভাগের প্রধান ড. ওয়াজেদ আলী বলেন, ক্রমান্বয়ে দেশীয় বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধ ও তাদের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। দেখা গেছে, জ্বালানির বর্ধিত ব্যয়ের কারণে বিদু্যতের উৎপাদন খরচও বাড়তি। তাই সাশ্রয়ী মূল্যে বিদু্যৎ বিতরণ ও লোডশেডিং না করার লক্ষ্যে আমদানি বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে দেশে মোট বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্র। যার মধ্যে ৪০ শতাংশই গ্যাস ভিত্তিক। কিন্তু গ্যাসের তীব্র সংকট ও বর্ধিত দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। এদিকে এ খাতে ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি তুলে নিয়ে প্রতি মাসে গ্রাহক পর্যায়ে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। ফলে ফেব্রম্নয়ারি ও মার্চে মোট ৮ শতাংশ বিদু্যতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছর দুই দফায় ১০ শতাংশ বিদু্যতের দাম বেড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি এক প্রতিবেদনের হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশের আইপিপি, এসআইপিপি ও রেন্টাল বিদু্যৎ কেনা বাবদ ব্যয় কমবে। এর বিপরীতে বাড়বে অন্যান্য উৎস থেকে বিদু্যৎ কেনার ব্যয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইপিপি ও এসআইপিপি থেকে বিদু্যৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। একইভাবে রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে এবার বিদু্যৎ কেনায় ব্যয় হবে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। যেখানে এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা।
আমদানি ও বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্র থেকে কম বিদু্যৎ কেনা প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশ্লেষক এম. শামসুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়া বিদু্যৎ খাতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ায় পরিস্থিতি এমন হয়েছে। এছাড়াও এদের উৎপাদন ব্যয় ও মূল্য নির্ধারণে গণশুনানি না থাকায় যেমন খুশি তেমন দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। তা না হলে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে এত পার্থক্য কেন থাকবে। এখন সরাসরি আমদানি করে বিদু্যৎ ঘাটতি মেটানো হলে ও এই বিপুল পরিমাণ বেসরকারি বিদু্যৎ কেন্দ্রের জন্য সরকারের ক্যাপাসিটি চার্যের কী হবে। দিন শেষে সব চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
\হ