ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাংগা এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) প্রতারণার মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার নামে টাকা আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব-১০। মঙ্গলবার রাতের্ যাব-১০ এর একটি দল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের মূল হোতা ইসমাইল মাতুব্বর (২১), ইব্রাহীম মাতুব্বর (২৭), মো. মানিক মতিউর রহমান (১৯), মো. সিনবাদ হোসেন (২৪), সুমন ইসলাম, মাহমুদুল হাসান পলক (২০), সাব্বির খন্দকার (১৯), মো. সাকিব (১৯) ও রাসেল তালুকদার (২৩)।
এ সময় ৩৬টি মোবাইল ফোন, ১২৬টি সিম কার্ড, ৫টি মোবাইলের চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ব্যাগ, ১০৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট ও ৮২ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
বুধবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে অবস্থিতর্ যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র?্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি কতিপয় প্রতারক চক্র রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান ও মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায়র্ যাব-১০ প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় বসবাসকারী ভুক্তভোগী ইসতাহাদ উদ্দিন সোহানের (১৯) মোবাইল নম্বরে গত ২২ মার্চ ৩টা ৩৬ মিনিটে কল দিয়ে তার নম্বরে উপবৃত্তির টাকা পাঠাবে বলে কৌশলে তার বিকাশের পিন নম্বর নিয়ে নেয় তারা। পরবর্তীতে ৩৮ লাখ ২৫৮ টাকা তার অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় তিনি কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
এছাড়া গত ২৪ মার্চ কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একই চক্র ২০ হাজার ৪০০ টাকা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা এলাকার লোকমান হোসেনের (৪৪) কাছ থেকে তার ছেলের নামে উপবৃত্তির কথা বলে ১৬ হাজার ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়।
এদিকে, মঙ্গলবার রাতের্ যাব-১০ এর একটি দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে চক্রের অন্যতম মূল হোতা ইসমাইল মাতুব্বরসহ (২১) চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ইসমাইল ফরিদপুর জুমুরকান্দার দেলোয়ার মাতুব্বরের ছেলে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- ছোট ভাই ইব্রাহীম মাতুব্বর (২৭), সহযোগী মো. মানিক ওরফে মতিউর রহমান (১৯) ও সিনবাদ হোসেন (২৪)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩৫টি সিম কার্ড, ৫টি মোবাইলের চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ব্যাগ ও ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
তদন্তকালের্ যাব-১০ আরও জানতে পারে অন্য আরেকটি প্রতারক চক্র গত ১৩ ফেব্রম্নয়ারি আব্দুল মমিন (৪২) নামে একজন নতুন বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ৪২ হাজার ৭৭৭ টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ডিএমপি ঢাকার ডেমরা থানায় তিনি একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
জিডির সূত্র ধরে একই তারিখ রাতের্ যাব-১০ এর দুটি পৃথক দল ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের অন্যতম মূল হোতা সুমন ইসলাম (২০), মাহমুদুল হাসান পলক (২০), সাব্বির খন্দকার (১৯), মো. সাকিব (১৯) ও রাসেল তালুকদারকে (২৩) গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ হতে ১৪টি মোবাইল ফোন, ৯১টি সিম কার্ড, ১টি ব্যাগ, ১০৪ পিস ইয়াবা ও ৫২ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
র?্যাব-১০ এর অধিনায়ক ফরিদ বলেন, গ্রেপ্তার ইসমাইল মাতুব্বর সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে পরস্পর যোগসাজশে চক্রটি প্রায় দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। নিরিবিলি স্থান হিসেবে তারা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকা বেছে নেয়, যাতে নিবির্ঘ্নে প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মো. সুমন ইসলাম মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের কাছ হতে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে পরস্পর যোগসাজশে চক্রটি প্রায় ৮-৯ মাস ধরে বিভিন্ন বিকাশ/নগদ ব্যবসায়ী এজেন্টদের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। তারা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে অবৈধ উপায়ে নতুন এজেন্টদের নাম্বার সংগ্রহ করত। সুমন প্রথমে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধিদের নম্বর ক্লোন করে বিভিন্ন বিকাশ/নগদ এজেন্টদের ফোন দিয়ে নিজেকে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধির পরিচয় দিত। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০টা নাম্বারে কল দিত। পরে বিকাশ/নগদ এজেন্টদেরকে হাজারে ৪ টাকার পরিবর্তে ৮-১০ টাকা লাভ করার বিভিন্ন অফার সম্পর্কে অবহিত করত। এক্ষেত্রে এজেন্টরা উক্ত অফার সম্পর্কে অবগত নয় বললে সুমন এজেন্টদের কাছ হতে বিকাশ/নগদের এসআরের ফোন নাম্বার নিয়ে ক্লোন করে উক্ত নম্বর হতে এজেন্টদের ফোন করে সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভের (এসআর) পরিচয় দিয়ে বলত 'উনি আমাদের বস, উনি যা বলেন সেভাবে কাজ করেন' বলে ফোন কেটে দিত। তারপর সুমন মোবাইলে ওটিপি প্রেরণের মাধ্যমে কৌশলে এজেন্টদের কাছ হতে বিকাশ/নগদের এজেন্ট নম্বরের পাসওয়ার্ডটি সংগ্রহ করত। একইভাবে একাধিক ভিকটিমদের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে এবং প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টে লগইন করে রাখত। অতঃপর উক্ত অ্যাকাউন্টে কোন টাকা প্রবেশ করা মাত্র সুমন মোবাইলে নটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে উক্ত টাকা তার অন্যান্য সহযোগী মাহমুদুল, সাব্বির, সাকিব ও রাসেলের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে রাসেল উক্ত টাকা তাদের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা হতে ক্যাশআউট করে সুমনের কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর উক্ত টাকা তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত। এই চক্রটি ২ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬০-৭০ জন বিকাশ/নগদ এজেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছ হতে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানায়।র্ যাব কর্মকর্তা জানান, তারা সবাই স্বল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার আশায় এবং মাদক সেবনের অর্থ যোগান দিতে এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।