আব্দুলস্নাহ'র নাবিকদের ঈদের আগে বাড়ি ফেরা নিয়ে সংশয়
'খাবারের সংকট আপাতত নেই, তবে পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। পানি শেষ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে এখন নাবিকরা সবাই রেশনিং করে অল্প পানি ব্যবহার করছেন'
প্রকাশ | ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুলস্নাহ ছিনতাইয়ের পর তিন সপ্তাহ পার হতে চলল। সোমালি জলদসু্যদের হাতে জিম্মি জাহাজটির নাবিকরা ঈদের আগে পরিবারের কাছে ফিরতে পারবেন কিনা, এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। যদিও জাহাজটির মালিকপক্ষ বলছেন, নাবিকদের দ্রম্নত মুক্ত করতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা
এমভি আব্দুলস্নাহ ছিনতাইয়ের পর প্রথম আট দিন 'চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়' কেটেছে জিম্মি নাবিকদের পরিবারগুলোর। ৯ দিনের মাথায় সোমালি জলদসু্যরা এমভি আব্দুলস্নাহ'র মালিকপক্ষ কবির গ্রম্নপের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কিছুটা আশার আলো দেখতে পান তারা।
এমভি আব্দুলস্নাহ'র চিফ অফিসার আতিকুলস্নাহ খানের মা শাহানুর বেগম বলেন, 'এরপর থেকেই আমরা অধীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি যে, কখন ছেলেটা মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসে। আমি চাই আমার ছেলে ঈদের আগেই ঘরে ফিরে আসুক।'
এমভি আব্দুলস্নাহ'র মালিকপক্ষও জানিয়েছে যে, ঈদের আগে নাবিকদের মুক্ত করতে তারা সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কবির গ্রম্নপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, 'আমরাও চাচ্ছি, ঈদের আগেই এই জিম্মিদশার অবসান হোক এবং সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে মুক্তি পেলেও এমভি আব্দুলস্নাহ'র নাবিকদের দেশে ফেরানো কঠিন হবে। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, 'জাহাজটি এখন যেখানে অবস্থান করছে, মুক্তি পেলেও ঈদের আগে সেখান থেকে বাংলাদেশে আসা সম্ভব হবে না বললেই চলে।'
এদিকে, যতই দিন যাচ্ছে, ততই এমভি আব্দুলস্নাহতে সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিফ অফিসার আতিকুলস্নাহ খানের মা শাহানুর বেগম। সোমালি জলদসু্যদের কাছে জিম্মি আতিকুলস্নাহর সঙ্গে তার পরিবারের সবশেষ যোগাযোগ হয়েছে রোববার সন্ধ্যায়। শাহানুর বেগম বলেন, 'খাবারের সংকট আপাতত নেই, তবে পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। পানি শেষ হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে এখন নাবিকরা সবাই রেশনিং করে অল্প পানি ব্যবহার করছে।'
মোজাম্বিক থেকে প্রায় ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাইয়ে যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ২৩ জন নাবিকসহ এমভি আব্দুলস্নাহকে জিম্মি করে সোমালি জলদসু্যরা। তখন জাহাজটিতে প্রায় ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি এবং মাসখানেকের হিমায়িত খাবার মজুত ছিল বলে জাহাজের মালিকপক্ষ জানিয়েছে। এর বাইরে কিছু শুকনা খাবার মজুত ছিল বলেও জানিয়েছে তারা। ফলে খাবার এবং পানি নিয়ে নাবিকরা সংকটে পড়বেন না বলে জানানো হয়েছিল।
কিন্তু জিম্মি করার পর অন্তত ২০ জলদসু্যর সবাই যখন নাবিকদের খাবারে ভাগ বসান, তখনই মূলত খাবার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। আট দিন পর জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে মুক্তিপণের বিষয়ে সমঝোতা শুরু হয়। ততক্ষণে এমভি আব্দুলস্নাহও সোমালিয়ার উপকূলে পৌঁছে যায়। ফলে জলদসু্যরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করায় নাবিকদের মধ্যে খাবার নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমে।
জিম্মি নাবিক আতিকুলস্নাহ খানের মা বলেন, 'কিন্তু দসু্যরা খাবার পানি এখনো জাহাজ থেকেই নিচ্ছে। সেই কারণেই পানির তীব্র সংকটে দেখা দিয়েছে।'
এদিকে, মুক্তি পাওয়ার পর জাহাজ নিয়ে রওনা হতে গেলেও সুপেয় পানির প্রয়োজন হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, 'এমনকি জাহাজের ইঞ্জিন স্টার্ট করতে গেলেও বেশ ভালো পরিমাণে ফ্রেশ ওয়াটারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সোমালিয়ায় ফ্রেশ ওয়াটার অতটা সহজলভ্য নয়। কাজেই এটি নিয়ে নাবিকদের দুশ্চিন্তা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে, একই জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা এবং লোনাপানিতে গোসল করার কারণে জিম্মি নাবিকদের অনেকের শরীরে চুলকানির মতো চর্মরোগ দেখা দিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।
শাহানুর বেগম বলেন 'আমার ছেলের আগে থেকেই এলার্জির সমস্যা। ওর শরীরে নাকি এখন চুলকানি হয়ে গেছে।' তবে মুক্তিপণের বিষয়ে জাহাজের মালিকপক্ষের সাথে সমঝোতা আলোচনা শুরু হওয়ার পর জলদসু্যরা জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে তুলনামূলক ভালো ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কয়লাসহ জাহাজ এবং জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে জলদসু্যদের সাথে সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এমভি আব্দুলস্নাহ'র মালিকপক্ষ কবির গ্রম্নপ। মূলত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া তৃতীয় একটি পক্ষের সহায়তায় সমঝোতা আলোচনাটি চালানো হচ্ছে।
কবির গ্রম্নপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, 'আলোচনায় বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলেই জলদসু্যরা জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন। আলোচনা ঠিকমত না এগোলে জলদসু্যরা এতদিনে হয়ত নাবিকদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিত।
এ ধরনের জাহাজ ছিনতাইয়ের পর জলদসু্যরা সাধারণত মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে থাকে। এর আগে, ২০১০ সালে এমভি জাহান মনি নামে কবির গ্রম্নপের আরও একটি জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালি জলদসু্যরা। তখনো মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিনের মাথায় সেটি মুক্ত করা হয়েছিল।
এমনকি সম্প্রতি সোমালি জলদসু্যদের কাছ ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা 'এমভি রুয়েন' নামে মাল্টার পতাকাবাহী যে জাহাজটি জব্দ করেছে, ছিনতাইয়ের পর সেটির মালিকপক্ষের কাছেও মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল।
ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে যে, এমভি রুয়েনের মালিকপক্ষের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি ভারতীয় রুপি সমমানের মুক্তিপণ চেয়েছিল সোমালি জলদসু্যরা। কিন্তু এমভি আব্দুলস্নাহর ক্ষেত্রে জলদসু্যরা কতটাকা মুক্তিপণ চাচ্ছে, সে বিষয়ে মুখ খুলছে না কবির গ্রম্নপ।
এমনকি জলদসু্যদের পক্ষ থেকে এখনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে কিনা, সেটিও স্পষ্ট করা হচ্ছে না।
মিজানুল ইসলাম বলেন, 'শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে, জিম্মি নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করার দরকার, সব চেষ্টায় আমরা করছি। জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শিগগিরই তারা এমভি আব্দুলস্নাহকে জলদসু্যদের কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জিম্মি করে সোমালিয়া উপকূলে নেওয়ার পর বেশ কয়েকবার অবস্থান পরিবর্তন করতে দেখা গিয়েছিল এমভি আব্দুলস্নাহকে। ছিনতাই হওয়ার পর থেকেই স্যাটেলাইট ইমেজ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজটির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তারা বলছে, এমভি আবদুলস্নাহ বর্তমানে সোমালিয়ার গদবজিরান এলাকার জিফল উপকূল থেকে প্রায় দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, 'মুক্ত হওয়ার পর জাহাজটির প্রথম কাজ হবে নিকটস্থ পোর্টে গিয়ে ফুয়েল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাপস্নই নেওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়া উপকূল ছেড়ে আসার পথে জ্বালানি নিতে হলে এমভি আব্দুলস্নাহকে থামতে হবে ওমানের সমুদ্রবন্দরে। সেখানে পৌঁছতে অন্ততপক্ষে তিন দিন সময় লাগবে বলে জানাচ্ছেন তারা।
আনাম চৌধুরী বলেন 'তখন মালিকপক্ষ চাইলে ওমানে জাহাজের নাবিকদের দল চেঞ্জ করতে পারবেন।' তবে সে জন্য আগে থেকেই নাবিকদের নতুন দলকে ওমানে প্রস্তুত রাখতে হবে। তারা জাহাজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে জাহাজের গন্তব্যস্থল দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা হবে।
আনাম চৌধুরী বলেন 'কারণ জাহাজের মালগুলো দুবাইয়েই পৌঁছানোর কথা ছিল এবং যেভাবেই হোক সেটি পৌঁছে দিতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক রীতি।
অন্যদিকে, ওমানে নেমে যাওয়া নাবিকরা শারীরিক পরীক্ষা ও অন্যান্য আইনগত বিষয় মিটিয়ে এরপর চাইলে বিমানে করে দেশে ফিরতে পারবেন। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। সব মিলিয়ে ঈদের আগে মুক্তি পেলেও বাড়িতে ফিরতে নাবিকদের আরও প্রায় দেড়-দুই সপ্তাহ সময় বেশি লেগে যাবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।