বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর পৌনে চার কি.মি. দৃশ্যমান
৫০টির মধ্যে ৪৯ পিলারের কাজ সম্পন্ন ট্রান্স এশিয়ান রেলপথে যুক্ত হওয়ার সক্ষমতা বাড়বে ঘণ্টায় ১০০-১২০ কি.মি. গতিতে চলবে ট্রেন
প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
প্রমত্তা যমুনার বুকে দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণের কাজ গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল অংশে ৯২ শতাংশ ও সিরাজগঞ্জ অংশে ৮০ শতাংশ। এর ফলে ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রেল সেতুর ৩.৭ কিলোমিটার এখন দৃশ্যমান। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেতুটি চালু হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থায় বৈপস্নবিক পরিবর্তন আসবে। অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্রান্সএশিয়ান রেলপথে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করবে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি বেগবান হবে।
যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মিত হচ্ছে। ডুয়েলগেজের এ রেললাইন দিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। তবে শুরুতে (উদ্বোধনের ১ বছর) সেতুর ওপর দিয়ে দুটি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ ট্রেন ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে।
নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রায় ৭ হাজার দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিকের দিনরাত পরিশ্রমে দ্রম্নত এগিয়ে চলেছে রেল সেতুর নির্মাণকাজ। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অংশে দুটি প্যাকেজের আওতায় ৫০টি পিলার ও ৪৯টি স্প্যানের সমন্বয়ে রেল সেতুটি নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪৯টি পিলারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ৩৭টি স্টিলের স্প্যান পিলারের ওপর বসানো হয়েছে। বাকি ১৬টি স্প্যান বসানোর কাজ চলছে।
এছাড়া রেলসেতুতে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ দুই ধরনের রেলসংযোগ তৈরি করতে দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট ও ৩০ কিলোমিটার ডাবল লাইনের রেলপথের কাজও দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলেছে। সেতুর স্প্যানে স্স্নিপারবিহীন রেললাইন বসানো হচ্ছে। দেশের রেললাইনে জাপানি এ প্রযুক্তির ব্যবহার এটাই প্রথম। এ প্রযুক্তিতে স্টিল স্ট্রাকচারের গার্ডারের সঙ্গে রেললাইনের সংযোগ প্রযুক্তিতে কোনো স্স্নিপার থাকবে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, যমুনার বুকে ভারী ভারী যন্ত্রের মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৪৯টি পিলার। উত্তাল যমুনার ওপর দেশের বৃহত্তম এ মেগা প্রকল্পকে ঘিরে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই প্রান্তে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিকরা বিরতিহীন কাজ করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে স্টিল অবকাঠামোর রেলসেতুটি চালু হবে। এটির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল হবে ১০০ বছর।
অন্যদিকে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণকালীন কিছু ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- অনুমোদিত ইএমপি অনুযায়ী সড়কের ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রকল্প এলাকার জনগণ ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টি।
এছাড়া প্রকল্পের কিছু দুর্বল দিকও প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবেদনে। এরমধ্যে রেলওয়ে সড়কবাঁধ নির্মাণে যথাযথ এবং অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসরণ না করা, প্রকল্পের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করা, চুক্তি মোতাবেক প্যাকেজ ডবিস্নউডি২-এর ল্যাবরেটরিতে মেশিনারি ও জনবল মোবালাইজ না করা, প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালট্যান্ট নিয়োগ না করা, প্যাকেজে ডবিস্নউডি-২ সম্পূর্ণ ল্যাবরেটরি টেস্টিং ইকু্যইপমেন্ট শ্রেণি বিন্যাস না করা ইত্যাদি।
জানা যায়, এক্সিট পস্ন্যান হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে প্রকল্পের ঠিকাদার প্যাকেজ ভিত্তিক এক বছর সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করবে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে এটি হস্তান্তর করা হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে সেতু এবং ভৌত অবকাঠামোর ডিজাইন লাইফ ১০০ বছর সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানবিরুল ইসলাম জানান, সেতুর পিলারগুলোর ফাউন্ডেশন জাপানি এসপিএসপি ফাউন্ডেশন পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে। আগামী মে মাসের মধ্যে পুরো স্প্যান বসানো সম্ভব হবে। এ সেতুর ফলে রেলের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহণে নিজেদের সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। সেতুটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগে যেমন গতি বাড়বে তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রেলে পণ্য পরিবহণে সক্ষমতা তৈরি হবে।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হবে। ইতোমধ্যে মোট প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল অংশে ৯২ শতাংশ ও সিরাজগঞ্জ অংশে ৮০ শতাংশ রয়েছে। এটি রেলের জন্য যুগান্তকারী একটি প্রকল্প। সেতুর ওপর দিয়ে ১২০ কিলোমিটার বেগে দুটি ট্রেন একত্রে চলাচল করতে পারবে।
তথ্য অনুযায়ী, ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলসেতুটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম সংশোধনীর পর সেতু প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন ২৭.৬০ শতাংশ বা চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এ অর্থ প্রকল্পের ৭২.৪০ শতাংশ।