একাকিত্ব আর অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা
ট্রেন আসতেই মেয়েকে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন মা
প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
রেললাইনের পাশে বসে মেয়ে মিমের সঙ্গে কেক খান লাকি বেগম। মেয়ের হাত ধরে রেললাইনের পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটেন। এরপর ট্রেন আসতে দেখে মেয়েকে টেনে নিয়ে তার নিচে ঝাঁপ দেন তিনি। আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় মা-মেয়ের জীবন।
সোমবার বিকাল ৩টার দিকে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটির পোলতাডাঙ্গা শ্মশানঘাট এলাকার রেললাইনে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন যশোর সদর উপজেলার বড় হৈবতপুর গ্রামের মৃত মকসেদ আলীর মেয়ে লাকি বেগম (৩৫) ও তার মেয়ে সুমাইয়া খাতুন মিম (১২)।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার বিকালে ওই এলাকায় রেললাইনের পাশ দিয়ে মেয়ের হাত ধরে হাঁটছিলেন লাকি বেগম। তখন বিপরীত দিক থেকে ট্রেন আসছিল। ট্রেনটি কাছে আসতেই
মেয়েকে নিয়ে রেললাইনের ওপর ঝাঁপ দেন মা। এ সময় ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা। ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, একাকিত্ব আর অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছেন মা ও মেয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বড় হৈবতপুর গ্রামের মকছেদ আলীর মেয়ে লাকি বেগম স্থানীয় সাতমাইল বাজারে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তার মেয়ে মিম একই গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'ফাঁকা মাঠের মধ্যে রেললাইনের পাশে বসে মা মেয়ে জন্মদিনের কেক খাচ্ছিলেন। কেক খাওয়ার মধ্যে ট্রেন চলে আসে। কালো বোরকা পরা ওই মহিলা তার মেয়ের হাত ধরে ট্রেন লাইনের ওপরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল।'
তিনি বলেন, 'বাঁচার জন্য মেয়েটি তার মায়ের হাত অনেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মা তার মেয়েটির হাত ছাড়েননি। মনে হয়েছে অনেক কষ্ট নিয়ে ওই মা তার মেয়েকে সাথে নিয়েই আত্মহত্যা করেছে।'
সরেজিমন দেখা গেছে, যশোর-ঢাকা রুটের রেললাইনের সদরের চুড়ামনকাটি শ্মশানঘাট এলাকায় রেললাইনের উপরেই মা-মেয়ের মরদেহ পড়ে রয়েছে। যেখানে মরদেহটি পড়ে রয়েছে তার থেকে ৫০ গজ দূরে লাইনের পাশে অর্ধেক খাওয়া একটি জন্মদিনের কেক ও কোমল পানীয় পড়ে আছে। পাশে কেক কাটার ছুরি। একটু দূরে পড়ে আছে মা-মেয়ের দুই জোড়া জুতা ও দুটি ভ্যানিটি ব্যাগ। এক সঙ্গে মা-মেয়ের এমন আত্মহননের খবর শুনে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সি মানুষ এসে ভিড় করেছেন।
রেললাইনের পাশে একটি মেহগনি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত লাকী বেগমের ছোট বোন রোজিনা বেগম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, '১২/১৩ বছর আগে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কবিরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় লাকীর। সেই ঘরের সন্তান মিম। মিম হওয়ার বছর চারেক পর লাকীকে ডিভোর্স দেন কবিরুল। এরপর তিনি বাবার বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। এর মধ্যে বড় হৈবতপুর গ্রামের এজাজুল ইসলামের সঙ্গে লাকী সম্পর্ক করে বিয়ে করেন। এই বিয়ের বছর দেড়েক পর এজাজুলও লাকীকে ডিভোর্স দেয়। ডিভোর্সের পর মেয়েকে নিয়ে লাকী স্থানীয় সাতমাইল বাজারে ভাড়া থাকতে শুরু করে। মাস তিনেক আগে আবারও এজাজুল লাকীকে বিয়ের করার প্রতিশ্রম্নতি দেয়। মাঝে মধ্যে এজাজুল লাকীর বাসাতে যাতায়াত শুরু করে। তিন মাসের মধ্যে এজাজুল লাকীকে বিয়ের প্রতিশ্রম্নতি দিলেও এজাজুল বিয়ে না করার টালবাহানা করে। এতে মেয়েকে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন লাকী।
তিনি অভিযোগ করেন, এজাজুল বারবার বিয়ের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েও বিয়ে না করায় তার বোন মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই হতাশার জায়গা থেকে তার বোন আত্মহত্যা করতে পারে।
লাকীর ভগ্নিপতি জুম্মান? আলী বলেন, 'একাকিত্ব ও অভাবের মধ্যেই লাকির সংসার পরিচালিত হচ্ছিল। লাকি হাতের কাজ করলেও সংসার ঠিকভাবে চলতো না। আমি বাজার করে দিলে তা দিয়েই চলতো। আমার মনে হয় অভাবের কারণে তিনি এ পথ বেছে নিয়েছেন।'
ঘটনার পরেই সেখানে যায় জেলা ডিবি পুলিশের একটি টিম। ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মফিজুল ইসলাম বলেন, 'ঘটনাস্থল থেকে এলাকাবাসী ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানায়। এরপর আমরা এসে দেখি ট্রেন লাইনের ওপরে দু'জনের মরদেহ পড়ে আছে। কাছে থাকা মোবাইল ফোন থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই নারী মেয়েকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে কী কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা এখনো জানা যায়নি। মরদেহের পাশ থেকে একটি বড় আকারের কেক, একটি মোবাইল ফোন ও দুটি ভ্যানিটি ব্যাগ পাওয়া গেছে। রেলওয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করেছে।'
যশোর রেলওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মনিতোষ বিশ্বাস জানান, 'খবর পেয়ে ট্রেনে কাটা মা ও মেয়ের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য যশোর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছেন। কী কারণে মেয়েকে নিয়ে ওই নারী আত্মহত্যা করলেন তা এখনো জানা যায়নি।'