পুলিশ সদস্য সোহেল তার ভাগ্নি মারিয়াকে নিয়ে ভৈরবে বেড়াতে যান। সেখানে তার অনুরোধে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মেঘনা নদীতে ঘুরতে বের হন। ইঞ্জিনচালিত ওই নৌকায় আরও কয়েকজন পর্যটক ছিলেন। মাঝি হাতের বৈঠা ছেড়ে তাদের ছবি তুলে দেওয়ার এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তখন বিপরীত দিক থেকে আসা বালুবাহী একটি বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকাটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় আমার ভাইয়ের পরিবার শেষ হয়ে গেছে। ভৈরবের মেঘনা নদীতে পর্যটকবাহী নৌকাডুবিতে নিখোঁজ পুলিশ সদস্য সোহেল রানার চাচাত ভাই ইমরান হোসেন এভাবেই বলছিলেন ঘটনাটি। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে মেঘনা নদীর দুই সেতু সংলগ্ন এলাকায় ওই ঘটনাটি ঘটে।
ইমরান হোসেন জানান, ভাগ্যক্রমে মারিয়া বেঁচে আছে। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মারিয়া জানিয়েছে- নৌকাটি যখন ডুবে যাচ্ছিল সে তার মামাতো ভাইবোনদের দু'জনকে দুই হাতে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তখন একজন তার হাত থেকে ছুটে যায়। সে অন্যজনকে শক্ত করে ধরে রাখে। কিন্তু যখন সে-ও ডুবে যাচ্ছিল তখন তার হাত ফসকে অন্যজনও ছুটে যায়। তখন মারিয়াও ডুবে যাচ্ছিল। শুধু দুই হাত ওপরে ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন তার হাত ধরে ওপরে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর মারিয়া বুঝতে পারে সে নৌকায় আছে।
এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় আরও দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার হলো। শনিবার দুপুর সোয়া ১টায় মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। তারা দু'জন হলেন নিখোঁজ পুলিশ সদস্যের স্ত্রী মৌসুমি ও তার কন্যা মাহমুদা। পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ বিষয়টি
নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, ঘটনার সময়ই অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার হওয়া এক নারীর পরিচয় শনিবার পাওয়া গেছে। তিনি ভৈরবের কমলপুরের সুবর্ণা (৪০)। এ তথ্য জানিয়েছেন ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহমেদ।
শনিবার দুপুর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন ৬ জন। তারা হলেন- ভৈরবের আমলা পাড়ার ঝন্টুদের স্ত্রী রূপা দে (৩০), টুটন দের ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে মেঘলা দে আরাধ্যা (১১) ও ঝুটন দে'র ভগ্নিপতি কটিয়াদী উপজেলার মানিকখালী এলাকার বেলন দে (৩৫), ভৈরব হাইওয়ে থানার কনস্টেবল কুমিলস্নার দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামের সোহেল রানা (৩০), পুলিশ সদস্যের ছেলে রাইসুল (৫) ও নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দাড়িয়াকান্দি গ্রামের দারু মিয়ার মেয়ে আনিকা ইসলাম।
এদিকে কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি মো. এনামুল হক জানিয়েছেন, ৫ জন ডুবুরি কাজ করছেন। নদী অনেক গভীর। নিচের দিকে প্রচন্ড স্রোতের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে।
শনিবার সকালে মেঘনা নদীর ভৈরব প্রান্তের সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও উৎসুক জনতার ভিড়। স্বজনরা নিখোঁজদের সন্ধানে অপেক্ষা করছেন। নিখোঁজদের উদ্ধারে কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস, ভৈরব ফায়ার সার্ভিস, ভৈরব থানা এবং ভৈরব, নৌ-থানা পুলিশ কাজ করছে।
নিখোঁজ আনিকার চাচাত ভাই আলমগীর মিয়া বলেন, 'মেঘনা নদীতে ঘুরতে আসার কথা বলে গতকাল বেলা তিনটার দিকে আনিকা ঘর থেকে বের হয়ে যান। এখনো তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না।'
অন্যদিকে কনস্টেবল সোহেল রানাসহ তার পরিবারের চারজন নিখোঁজের ঘটনায় দিশাহারা স্বজনরা। সোহেল রানার বাড়ি কুমিলস্নার দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামে। তার ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ভৈরব হাইওয়ে থানায় সাত মাস আগে যোগ দেন সোহেল রানা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভৈরবেই থাকতেন। রাতে দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে তারা ভৈরবে আসেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনা নদীর ভৈরব এলাকায় পাশাপাশি দুটি রেল ও একটি সড়ক সেতু আছে। তিনটি সেতু ঘিরে ভৈরব প্রান্তে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে মেঘনা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। গতকাল বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে একটি নৌকায় ১২ থেকে ১৫ জন দর্শনার্থী যাত্রা করেন। মাঝনদীতে যাওয়ার পর কয়েকজন যাত্রী মাঝিকে ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তখন তিনি বইঠা ছেড়ে ছবি তুলে দিচ্ছিলেন। এ সময় নৌকাটি কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। তখন বিপরীত দিক থেকে আসা বালুবাহী একটি বাল্কহেড নৌকাটি ধাক্কা দিলে সেটি উল্টে যায়।
বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকাডুবির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিন মাঝিকে আটক করেছে নৌপুলিশ। এ সময় ধাক্কা দেওয়া বালুবাহী বাল্কহেডটিও জব্দ করা হয়েছে।