রাজধানীতে কিউলেক্স মশার প্রকোপ ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। গ্রীষ্মকাল আসার আগেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। কোনো কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে মশার বিস্তার। গবেষণা বলছে, জানুয়ারি মাসের তুলনায় চলতি মার্চ মাসে কিউলেক্স মশার পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেড়েছে। রাজধানীর দুই সিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মশা বেড়েছে উত্তর সিটিতে। এই সিটির দক্ষিণখান ও উত্তরা এলাকায় মশার দাপট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গবেষকরা বলছেন, সংশ্লিষ্টরা যথাসময়ে নজর দিলে মশার ঘনত্ব কমে আসত। নগরবাসীরও অভিযোগ, মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনেরই তৎপরতা খুব কম। যদিও দুই নগর সংস্থাই দাবি করেছে, মশা নিধনে নিয়মিত কাজ করছেন তারা। তবে গবেষণায় মশা বেড়ে যাওয়ার তথ্য সামনে আসায় করপোরেশনের 'তৎপরতা' কতটা কাজে দিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি এবং সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক ধারাবাহিক জরিপে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি মাসের তুলনায় চলতি মার্চ মাসে কিউলেক্স মশার পরিমাণ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। গবেষণার নেতৃত্ব দেওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, 'গত বছরের অক্টোবর থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে মশার ওপর জরিপ করছি; এবং প্রতি মাসে আগের মাসের তুলনায় মশার বৃদ্ধি দেখছি।'
কীটতত্ত্ববিদেরা জানান, দেশে মশা আছে প্রায় ১২৩ প্রজাতির। এর মধ্যে ১৬ প্রজাতির মশার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে যে কয়েক প্রজাতির মশা থাকে, তার মধ্যে কিউলেক্স মশা ৯৫ শতাংশের বেশি।
সাম্প্রতিক গবেষণায় এক ধরনের বিশেষ ফাঁদ ব্যবহার করে রাজধানীর দক্ষিণখান, উত্তরা, মিরপুর, সাভার ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় মশা ধরা হয়। প্রতিটি ফাঁদে কতটি মশা ধরা পড়ল তা হিসাব করে মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় পাওয়া তথ্যের বরাতে অধ্যাপক কবিরুল বাশার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পাতা প্রতিটি ফাঁদে গড়ে ২০০টি মশা ধরা পড়ত। ডিসেম্বর মাসে সংখ্যাটি বেড়ে হয় ২২৩টি। আর জানুয়ারিতে বেড়ে হয় ৩০০টি, ফেব্রম্নয়ারিতে ৩৮৮টি এবং মার্চ মাসে প্রতিটি ফাঁদে ধরা পড়া মশার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪২০টি।'
তিনি বলেন, 'ডোবা-নালা কম থাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কিউলেক্স মশার সংখ্যা উত্তর সিটি করপোরেশনের চেয়ে কম। এ পর্যন্ত ফাঁদে যে মশা ধরা পড়েছে, তার ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। বাকি ১ শতাংশের মধ্যে এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া মশা।'
মশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ড. কবিরুল বাশার জানান, শীতকালে যখন বৃষ্টি থাকে না, তখন ড্রেন, ডোবা নর্দমার পানি ঘন হয়ে পানিতে জৈব উপাদান বেড়ে যায়। এ সময় কিউলেক্স মশার প্রচুর প্রজনন ঘটে। আর এই কারণেই মশা বেড়ে গেছে। বর্তমানে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব ৯৫ শতাংশের বেশি হওয়ায় তা খুবই ভয়ংকর অবস্থা বলেও জানান তিনি।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা এও অভিযোগ করছেন, সিটি করপোরেশন মশা নিধনে তেমন কাজ করছে না।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা আবিদ হাসান জানান, এই এলাকায় সারাবছরই মশার উপদ্রব আছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম খুব একটা দেখা যায় না। মশার উৎপাত থেকে বাঁচতে কয়েল, অ্যারোসল ব্যবহার করি। প্রায় সব ঘরেই মশা মারার ব্যাট রাখা হচ্ছে। কেউ কেউ মশা প্রতিরোধে বাসার জানালায় লোহার জালি যুক্ত করেছেন। সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়ার প্রথম বছর মশক নিধন কর্মসূচি বেশি ছিল। তেমন সক্রিয়তা আবার দাবি করেন তিনি।
মিরপুরের বাসিন্দা বিলকিস বেগম জানান, সন্ধ্যার আগে থেকেই তার এলাকায় মশার উপদ্রব শুরু হয়। সেজন্য বিকালেই বাসার জানালা বন্ধ দেন। তারপরও মশা থেকে বাঁচতে পারেন না।
তার ভাষ্যে- 'কীভাবে যেন বাসায় মশা ঢুকে যায়! রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাই। কিন্তু অনেকবার মশারি থেকে বাইরে আসতে হয়, তখন মশারির ভেতরেও মশা ঢোকে। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমার বাচ্চাটাকে মশা কামড়ায় বেশি। সে বলতে পারে না, মশা গায়ে বসলে বুঝতেও পারে না।'
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে কবীর বলেন, 'দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে কম। আমরা নালা, ড্রেন, জলাশয় এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে মশার ওষুধ স্প্রে করছি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আমরা আশা করছি, মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবো।'
উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'ডিএনসিসি এরইমধ্যে মশক নিধনে অভিযান শুরু করেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কিউলেক্স মশা নিধনে আমাদের সব ফোর্স কাজে লাগিয়েছি।'