এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির গোয়েন্দা সতর্কতা
প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আট বছর পেরিয়ে গেলেও শতভাগ এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসেনি। প্রতারক চক্র এমন দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারে। এতে করে বুথ থেকে গ্রাহকের টাকা চুরির আশঙ্কা দেখছে গোয়েন্দারা। এজন্য ৯ জন বিদেশি ও ৪ জন বাংলাদেশিসহ ১৩ জনকে খোঁজা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, শতভাগ এটিএম বুথে এখনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসেনি। ফলে চলমান রোজা বা ঈদে বুথ থেকে টাকা চুরির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এটিএম কার্ড প্রতারক চক্রের মূল হোতাদের অধিকাংশই বিদেশি। তারা বাংলাদেশি কিছু প্রতারকের সহায়তায় বুথ থেকে টাকা চুরি করে। চক্রটি গত কয়েক বছরে অন্তত একশ' কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক চক্র এটিএম বুথের কোনো সুবিধাজনক জায়গায় স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে রাখত। গ্রাহক টাকা তোলার জন্য কার্ডের গোপন পিন নম্বর টিপলেই সেই তথ্য চলে যেত চক্রের পেতে রাখা ডিভাইসে। সেই তথ্য দিয়ে তারা এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা তুলে নিত। এখন পর্যন্ত ক্লোন করা ১১৬০টি এটিএম কার্ড জব্দ হয়েছে। যার মধ্যে ৪০টি কার্ড দিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে চক্রের প্রধান জার্মানির নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক (৫০) ও সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) এবং রেফাত আহমেদ রনি (৪২)।
গ্রেপ্তারদের বরাত দিয়ে সূত্রটি জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো পৃথিবীতেই এটিএম কার্ড ক্লোন চক্র সক্রিয়। গ্রেপ্তার চক্রটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬শ' কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় একশ' কোটি টাকা। চক্রটির সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী পলাতক দুই বাংলাদেশি ছাড়াও চার বিদেশির জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। পলাতক বিদেশিরা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। গ্রেপ্তার পিওটর বিশ্বের ৪টি দেশে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে তালিকাভুক্ত। তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক পরিচয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
র্
যাবের সাইবার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চলা অভিযানে গ্রেপ্তারদের মধ্যে ১১ জন আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াত চক্রের সদস্য। চক্রের মূল হোতা সোহেল। সোহেল দুবাই থাকার সময় এরিন লিমো নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিকের মাধ্যমে এটিএম কার্ড জালিয়াতির কৌশল শিখে। এরিক লিমো ১২ বছর ধরে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। চক্রটির সঙ্গে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী আন্তর্জাতিক কার্ড জালিয়াতি চক্রের যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে। এরিক লিমোকে আইনের আওতায় আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তাদের হাতে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৪০০ ক্লোন এটিএম কার্ড, একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড রিডার ও রাইটার, ৩টি পজ মেশিন, তথ্য চুরির কাজে ব্যবহৃত ডিজিটাল হাতঘড়ি, ২টি মিনি কার্ড রিডার ডিভাইস ও ১৪টি পাসপোর্টসহ বহু আলামত জব্দ হয়েছে।
সূত্রটি বলছে, তদন্তে এখন পর্যন্ত ব্র্যাক, সিটি ব্যাংক, ইবিএল ব্যাংক, ইউসিবিএল ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং ব্যাংক এশিয়ার এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ চক্রের হোতা শরিফুলকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে এসব তথ্য।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চলা অভিযানে শুধু ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ক্লোন করা কার্ড দিয়ে টাকা চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছে ইউক্রেনের নাগরিক দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), আলেগ শেভচুক (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কিকে (৩৭)।
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, সবশেষ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের খিলগাঁও এলাকার একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির সময় গ্রেপ্তার হয় তুরস্কের নাগরিক হাকান জানবারকান। ইতোপূর্বে ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। হাকানের কাছে পাওয়া গেছে ১৭টি ক্লোন করা এটিএম কার্ড, একটি ল্যাপটপ, বিভিন্ন মডেলের ৫টি মোবাইল ফোন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, হাকান আন্তর্জাতিক এটিএম কার্ড জালিয়াতি চক্রের সদস্য। তার নেতৃত্বে রয়েছে বিশাল এক চক্র। চক্রটিতে রয়েছে তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মেক্সিকো, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। হাকান ইস্টার্ন ব্যাংকের (ইবিএল) বিভিন্ন বুথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জার্মানি, তুরস্ক, সৌদি আরব, স্পেন, নরওয়েসহ ৪০টি দেশের নাগরিকদের এটিএম কার্ড ক্লোন করে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। চক্রের পলাতক দেশি-বিদেশি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও বলেন, এটিএম বুথ শতভাগ নিরাপদ করা প্রয়োজন। অন্যথায় এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির সম্ভবনা থাকবেই। এজন্য শক্তিশালী প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। অন্যথায় যেসব এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস নেই বা প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা শক্তিশালী নয়, সেসব ব্যাংকের বুথ থেকে যেকোনো সময় টাকা চুরির সম্ভবনা থেকেই যাবে।
তিনি আরও জানান, এটিএম কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ৯ বিদেশি ও তাদের ৪ বাংলাদেশি সহযোগীকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের কাছে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে ইন্টারপোলের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলছেন, পলাতকদের মধ্যে দুই বাংলাদেশি ও এক বিদেশি লন্ডনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। বাকিরা যেসব দেশের নাগরিককে সেই সব দেশকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে পলাতকদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে ইন্টারপোলকে অনুরোধ করা হয়েছে।
সিআইডি সাইবার বিভাগ বলছে, এ ধরনের অপরাধ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। এজন্য এ ধরনের অপরাধের আদ্যোপান্ত জানতে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক টিম গঠন করা হয়েছে। যেসব দেশের নাগরিকরা এ ধরনের অপরাধে জড়িত ওইসব দেশকে গঠিত টিমের সদস্য করা হয়েছে। ওইসব দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রেপ্তারদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। টিমের অন্যতম প্রধান সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্রটি আরও জানায়, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে নিজের নাম ঠিকানা ভুল দিয়ে প্রবেশ করে এমন অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। চক্রের সদস্যরা কীভাবে এটিএম কার্ড ও এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয় সে বিষয়ে গোয়েন্দারা তদন্ত করে যাচ্ছে।
তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ বু্যরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২৩১টি এটিএম বুথ থেকে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্য। তাদের অনেকেই আদালতে অপরাধের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় বিচারকের জবানবন্দি দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, গ্রেপ্তাররা এটিএম বুথে থাকা বাক্সে টাকা রাখত। যথারীতি বুথ সচল করত। এরপর সেই টাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের নামে করা কার্ড দিয়ে তুলে নিত। এখানে তারা বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করত। কারণ যাদের কার্ড ব্যবহার করে মোটা অংকের টাকা তোলা হতো, সেই পরিমাণ টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে থাকত না। তারা বিশেষ কৌশলে ব্যাংকের মূল সার্ভার স্টেশনে মিথ্যা স্টেটমেন্ট পাঠাত। তাতে দেখানো হতো, গ্রাহকরা ওই টাকা তুলে নিয়েছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন গ্রাহক ব্যাংকে অভিযোগ করলে তদন্তে বেরিয়ে আসে এমন তথ্য।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশের ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, প্রায় শতভাগ ব্যাংকের এটিএম বুথেই এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য আছে। যে কারণে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার তেমন কোনো সম্ভবনা নেই। এমনকি এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা চুরি করাও প্রায় অসম্ভব।
তিনি আরও বলেন, তবে নানা কৌশলে প্রতারক চক্র কোনো ব্যক্তির এটিএম কার্ডের গোপন পিন নম্বর জেনে নিয়ে টাকা চুরি করতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি ব্যাংককে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বুথে সচল সিসি ক্যামেরা ও সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরির ঘটনা ঘটছে। তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ২০১৬ সালে। এখন পর্যন্ত এটিএম বুথ থেকে টাকার চুরির অভিযোগে ইস্টার্ন ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল), সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমন ঘটনার পর ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রত্যেকটি সরকারি, বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংককে তাদের এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসানোর কড়া নির্দেশনা জারি করে।