মরুকরণের পথে বরেন্দ্র অঞ্চল। দ্রম্নত ফুরিয়ে যাচ্ছে ভূ-গর্ভের পানি। বছর বছর পানির স্তর নিচে নামছে। ফলে ক্রমেই বাড়ছে পানি সংকট। এতে প্রভাব পড়ছে কৃষি, অর্থনীতি ও জনজীবনে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এখনই পানির ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে নওগাঁয় ভূ-গর্ভস্থ পানির বর্তমান অবস্থা ও করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার দুপুরে নওগাঁ শহরের উকিলপাড়ায় বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) মৌসুমি মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও একুশে পরিষদ নওগাঁ এর আয়োজন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় এক হাজার ১০০ মিলিমিটার। ১০ বছর আগে বছরে গড় বৃষ্টি হতো
এক হাজার ৫০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমার পাশাপাশি কৃষিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বছরে এখানে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে প্রায় পৌনে এক ফুট। ভূ-গর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে উচ্চ ফলনশীল ফসল চাষাবাদ করাসহ কম পানি ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে ব্যবহার ও জনসচেতনা বৃদ্ধি করা নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে আলোচনায় বেশি ওঠে আসে ধান উৎপাদন নিয়ে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে বাংলাদেশে ৬৫০ লিটার পানির প্রয়োজন। এক কেজি ধান থেকে মোটামুটি ৬৬০ গ্রাম চাল পাওয়া যায়। যেখানে একজন বাঙালি ৪০০ গ্রামের মতো ভাত খায়। অর্থাৎ দেড় দিনের ভাতের চাল উৎপাদন করতে পানির দরকার হয় ৬৫০ লিটার। এটি আবার স্বাদু বা মিঠা পানি।
জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলার আংশিক এলাকা। সাপাহার উপজেলার কিছু এলাকায় ১৯০ ফুট থেকে ২৫০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যায়। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি কয়েক ফুট নিচে নেমে গেছে। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় পানি উত্তোলন করতে একদিকে যেমন সময় বেশি লাগছে। অপরদিকে বিদু্যৎ খরচও বেশি পড়ছে। প্রতি ঘণ্টায় ১০-১২ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক দিকে দিয়েও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ ও পানির ব্যবহার কমাতে কম সময়ে উচ্চ ফলনশীল চাষাবাদ বাড়াতে হবে।
মৌসুমি উপসহকারী কৃষি অফিসার লিয়াকত আলী বলেন, প্রতিদিন সাংসারিক বিভিন্ন কাজে আমরা প্রায় ৫০ লিটার পানি ব্যবহার করে থাকি। পানির অপচয় রোধ করতে এবং উঁচু ভবনের ছাদে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু পদ্ধতি পরিবর্তন করে পানি সংরক্ষণ ও অপচয় রোধ করা সম্ভব।
বাপা সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় ধানের আবাদ করা হচ্ছে। আর ধান চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এটি পানি সংকটের একটি কারণ। তবে যে এলাকায় যেসব ফসল চাষে উপযোগী সেসব ফসল রোপণ করা দরকার। এতে করে পানির সাশ্রয় হবে।
নওগাঁ সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কৃষিকাজে পানি ভূ-গর্ভস্থের ৯০ শতাংশ, শিল্প ও কলকারখানায় ৬ শতাংশ এবং প্রাত্যহিক বা খাবার কাজে ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কৃষিতে অতিরিক্ত যে পানি ব্যবহার হচ্ছে তা কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করার অভ্যস্থ হতে হবে।
তিনি বলেন, ভূ-গর্ভের নিচে পাইরেক্স শিলা অবস্থিত। যেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানি বিদ্যমান। শুষ্ক মৌসুম এটি নিচের দিকে নেমে যায় এবং বর্ষা মৌসুমে ওপরের দিকে আসে। অতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে এই শিলার পানি শুকিয়ে যাবে। এতে এক ধরনের মৌলিক পদার্থ অর্থাৎ আর্সেনিক নির্গত হবে। এই পানি ব্যবহারের ফলে জনজীবনে ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে। তাই ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার কমাতে হবে।
একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারীর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, নওগাঁ সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম খান, মৌসুমির নির্বাহী পরিচালক হোসেন শহীদ ইকবাল রানা, উপনির্বাহী পরিচালক ইরফান আলী, ডা. ময়নুল হক দুলদুল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন জেলা শাখার সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মকুল চন্দ্র কবিরাজ ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম. এম রাসেলসহ অন্যরা। এ সময় জেলার সংবাদকর্মী, সরকারি দপ্তরে কর্মকর্তা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
সাপাহার উপজেলার বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সহকারী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম বলেন, এলাকাভেদে পানির গভীরতা ১৯০ থেকে ২৫০ ফুট। বেশ কিছুদিন থেকে পানির স্তুর নিচে নেমেছে। এতে করে পানি উত্তোলন করতে খরচ বেশি পড়ছে। প্রতি ঘণ্টায় বলা যায়, ১০-১২ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এর কারণ ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর কমছে।