ঢাকার 'শ্বাসনালি' বুড়িগঙ্গাকে গিলে খাচ্ছে অবৈধ স্থাপনা

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
সীমানা পিলার বসানোর পরও বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এখনো রয়ে গেছে অবৈধ স্থাপনা। ছবিটি কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি
এক সময়ের স্রোতঃস্বিনী বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা শহর। নদীটিকে বলা হতো ঢাকার শ্বাসনালী। কিন্তু দখল-দূষণে নদীটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। নদীর পাড়ে নেই সবুজের ছিটেফোঁটা। এছাড়া গত ৩০ বছরে নদীপাড়ে ব্যাপকহারে বেড়েছে জনবসতি। নদীর ৪১ কিলোমিটারের ১৬ কিলোমিটারই ভরাট আর দখলে প্রবাহ শূন্য হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষা ও শরতে এ নদীর পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকে। আর বাকি চার ঋতুতে বেড়ে যায় তাপমাত্রা। ভয়াবহ দূষণের শিকার হওয়ায় নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। আগে হাজারীবাগের চামড়া কারখানার বর্জ্য গিয়ে মিশতো পানিতে। পরে চামড়া কারখানা সাভারে সরিয়ে নেওয়ার পরও বুড়িগঙ্গার অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। নদী রক্ষা কমিশনের পরিদর্শন তথ্য বলছে, ঢাকার মধ্যে ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, সাভার ও দোহারে ১১০ কিলোমিটার নদী আছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ৮ কিলোমিটার, তুরাগ ৪২ কিলোমিটার, বালু ২৭ কিলোমিটার, ইছামতি ১১ কিলোমিটার, ধলেশ্বরী ১২ কিলোমিটার ও বংশী ১০ কিলোমিটার। এসব নদীর মধ্যে কমিশনের পরিদর্শন অনুযায়ী, ২৩৫টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ইছামতিতে ৭৫টি, ধলেশ্বরীতে ১০০টি আর বংশীতে ৬০টি স্থাপনার তালিকা আছে কমিশনের কাছে। এর বাইরে আরও অনেক অবৈধ স্থাপনা আছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কিন্তু সে তালিকা কমিশনের কাছে নেই। তবে চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হচ্ছে না- তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দখল-দূষণকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রভাবশালীদের। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, 'কমিশনের শুরুতেই দখলদারদের তালিকা করেছিলাম। কিছু উচ্ছেদও হয়েছিল। মূল সমস্যা হচ্ছে বড় ব্যবসায়ী এবং তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ। এ কাজে পানিসম্পদ এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদী রক্ষা আইন সংশোধন করে সংসদে পাঠানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও চান নদীগুলো রক্ষা পাক। কিন্তু সুবিধাভোগী কিছু মানুষের কারণে দখলমুক্ত হচ্ছে না। আইন না হলে, মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা না পেলে এ কাজ একা কমিশনের পক্ষে করা সম্ভব নয়।' কেরানীগঞ্জের আগানগর ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, 'ইদানীং এত পরিমাণ ময়লা হয়েছে যে নদীতে পারাপার হতেও কষ্ট হয়। নদী পানিতে প্রচন্ড দুর্গন্ধ যা সহ্য করার মতো নয়।' এক সময়ের স্রোতঃস্বিনী নদীটিকে একরকম গিলে খাচ্ছে কেবল দখলদারদের অবৈধ স্থাপনা। সেই সঙ্গে সব জায়গায় আশপাশের কারখানার লাখো-কোটি টন বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার চিত্র। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে সাজা নিশ্চিত করলেই বাঁচানো যাবে বুড়িগঙ্গা। এমনটাই দাবি পরিবেশকর্মীদের। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, 'এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে অন্য নদ-নদীর পানিও বুড়িগঙ্গার মতোই ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়বে। বুড়িগঙ্গা বর্জ্য ফেলার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অন্তত তিন দশক ধরে। দুই তীরে গড়ে ওঠা সব কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গার দূষণ এখন আর এ নদীতে সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদপুর অঞ্চলের পদ্মা-মেঘনার মোহনায়ও। আড়িয়াল খাঁ, গোমতী, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে অনুভূত হচ্ছে দূষণের থাবা।' এদিকে তিন দশকে বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য, দূষণ, দখল নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাতটি প্রতিষ্ঠান। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। পাঁচশ' বছরের ঢাকা গড়ে ওঠে বুড়িগঙ্গা তীর ধরে। কিন্তু সময়ের স্রোতে বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে গতিপথ, প্রবাহ। দখল দূষণে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে এই নদী। ধলেশ্বরীর কেরানীগঞ্জে হযরতপুর থেকে উৎপত্তি হয়ে কোন্ডা ইউনিয়নের জাজিরায় মিশেছে ৪১ কিলোমিটারের বুড়িগঙ্গা। অথচ গত ত্রিশ বছরে এই উৎস মুখ থেকে ১৬ কিলোমিটারই দখল হয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্প কারখানা ও ১৭টি ইটভাটা। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, 'আমরা নদীকে নানা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মাপি, কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাপি, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভাবি, ভারত কিংবা বাংলাদেশ আমরা একটি জীবন্ত নদীকে কেটে ফেলতে চাই, কত কিউসেক পানি আমরা পেতে পারি। বনের গাছকে ঘনফুটে মাপি। অথচ এই নদী, প্রাণ- প্রকৃতি হলো এক একটি জীবন। সবার আগে সরকার ও রাষ্ট্রের এসব দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নদীতে, বনে-জঙ্গলে কত শতাংশ জায়গা আছে এসব হিসেব-নিকেশের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়ানোটা জরুরি এবং আমি মনে করি এই গবেষণা আমাদের এভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।' রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে। রাজধানীর শ্বাসনালী পুনরুদ্ধারে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পরিবেশবিদ ও বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'উন্নয়নের নামে দেশের নদ-নদী ও পরিবেশ ধ্বংস করা চলবে না। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাকে পুনরুদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।' স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'স্বাধীনতার আগে দূষণের কেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জ। এরপর হাজারীবাগের ট্যানারি। এখন ট্যানারি সাভারে গেছে। দূষণের কেন্দ্রও বদলেছে। তবে মাথায় রাখতে হবে দূষণের মূল কারণ কারখানা। কারখানা বন্ধ করতে বলছি না। পরিশোধন পস্ন্যান্ট করার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছি। আমাদের গবেষণায় বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্যাডমিয়াম, সালফাইড ও অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি অনেক বেশি পেয়েছি। তিনি আরও জানান, আগে বর্ষায় দূষণের মাত্রা কম হতো। এ বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত জরিপে দেখা গেছে মাত্রা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি।'