অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতেও যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তা থেকে বেশিরভাগ দেশ বেরিয়ে আসলেও বাংলাদেশে এটি কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। খবর বিবিসি বাংলা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আরও নানা বিষয় প্রভাব ফেলেছে। যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে অর্থ পাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা।
তারা বলছেন, দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রম্নয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬৭ শতাংশে। জানুয়ারিতে এটি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এই উচ্চহার চলছে।
মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে বছর দুয়েক আগে বিশ্বের সাথে সাথে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে বাংলাদেশও একটি। তবে শুধু পাকিস্তান ছাড়া এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে কমেনি।
বাংলাদেশ যা যা করেছে : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা ভোক্তা মূল্য সূচক বা সহজে বলতে গেলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। ফেব্রম্নয়ারিতে এটি কমে ৯.৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি এখনো সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি।
আইএমএফ-এর ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। তার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুদ্রানীতিতে কঠোরতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে নীতি-সুদ হার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে আরও বেশি সুদ দিতে হবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। এছাড়া ডলারের দাম নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে করে ডলারের দাম অর্থনীতির সাথে মিল রেখে ওঠানামা করবে।
একই সাথে খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগে 'সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি' গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারের নির্ধারিত মাত্রার বিষয়টি তুলে নেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
নিত্য ব্যবহার্য অনেক পণ্য আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে কিছু পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এতসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না।
সফল হয়নি কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি না কমার পেছনে দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কিছু বাজার ভিত্তিক। আর কিছু রয়েছে বাজারবহির্ভূত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ডলার সংকটের কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। যে পরিমাণ ডলার আয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ডলার দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে। আর এর পেছনে স্বাভাবিক কোনো কারণ আছে বলে তিনি মনে করেন না। বরং অসাধু উপায়ে ডলার পাচারের কারণে এমনটা হচ্ছে। আর এটা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।
তিনি আরও বলেন, 'দ্বিতীয়ত, উৎপাদক ও ভোক্তার দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এর কারণ হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কয়েক হাত বদল এবং নানা ধরনের চাঁদাবাজি। অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হওয়ার কারণে চূড়ান্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে পণ্য সরবরাহের সুযোগ কুক্ষিগত থাকায় তারাই পণ্যের দাম নির্ধারণ করছে। ফলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা কাজ করছে না।'
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'কিছুদিন আগে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেছিলেন যে, এই সিন্ডিকেট হচ্ছে আমাদের সরকারের চেয়ে মোর পাওয়ারফুল। এটাকে আর দমন করতে পারছি না।' এ ধরনের কারণে বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, উল্টোভাবে দেখতে গেলে শ্রীলঙ্কা খারাপ অবস্থানে থাকার পরও সেখানে এ ধরনের অনুঘটক না থাকার কারণে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। শ্রীলঙ্কা আমদানি-রপ্তানি, টু্যরিজম করে, ডলারটা নিজের দেশে এনে, ভারত থেকে
\হ
বৈদেশিক সাহায্য এনে, যেমনি পারে ডলারের মানটাকে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে।
এম এম আকাশ বলেন, সেখানে যে সিন্ডিকেট ছিল সেটা ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার কারণে ভেঙে পড়েছে। সুশাসন কায়েম হওয়ার ফলে এ ধরনের সমস্যা কমে এসেছে। তুলনামূলক বিচারের একই সারমর্মে পৌঁছাবেন, বাংলাদেশে যে কারণগুলো সক্রিয় আছে, অন্যান্য দেশে সে কারণগুলো সক্রিয় নেই। সে কারণে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না।
তিনি মনে করেন, যারা অর্থ পাচার করছে, যারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। তবে এটা সহজ নয় বলেও মনে করেন তিনি। কারণ বাংলাদেশে স্বজন-পোষণমূলক পুঁজিবাদ প্রচলিত রয়েছে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সেখানে স্বজনদের ওপর সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ওই স্বজনরাই আবার সরকারের পলিসি বা নীতিকে কন্ট্রোল করে। সুতরাং এটা এলিট ক্যাপচার অব রেগুলেটরি বডি- এই সিনড্রোমে বাংলাদেশ ভালোভাবে পড়ে গেছে।'
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে যাদের রিজার্ভ কম, তাদের জ্বালানি আমদানিতে উচ্চ মূল্য দিতে হয়। তাই ডলারের ঘাটতি হয় এবং এর জন্য আমদানি ব্যয় বাড়ে। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে রয়েছে। এটা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও রয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এসব দেশ কতটা কৃচ্ছ সাধন করতে পারে। এসব দেশের ব্যয় সংকোচন খুবই কঠোর হাতে করতে হয়। যেটি বাংলাদেশে হয়নি।