চিনির গুদামে আগুন

খাতুনগঞ্জে প্রভাব, সমালোচনার মুখে এস আলম গ্রম্নপ

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা এলাকায় গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে। বাজারে প্রতিকেজি চিনি দুই থেকে তিন টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে এস আলম গ্রম্নপ। বুধবার দুপুরে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'চট্টগ্রামের একমাত্র চিনির কারখানা এস আলম সুগার মিলে মজুত করা এক লাখ টন চিনি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাজারে কমবেশি এর প্রভাব তো পড়বেই। সোমবার বিকালে গুদামে আগুন লাগার পর মঙ্গলবার সকাল থেকেই খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৫০ টাকায়। এর আগে সোমবার সকালে প্রতিমণ বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৫ টাকায় যা কেজিপ্রতি ৩ টাকা বেশি। ফলে খুচরায়ও বেড়েছে।' খাতুনগঞ্জের চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, 'এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগাটা একটি দুর্ঘটনা। তার মানে অন্য মিলগুলোতে চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। সব মিলেই চিনি রয়েছে। এখন এস আলমের মিলে আগুন লাগার সুযোগ নেওয়ার পাঁয়তারা করছে ঢাকার মিলগুলো। এতে চিনির দাম বাড়ছে।' তিনি উলেস্নখ করেন, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের হাতে চিনির বাজার নেই। এখানকার ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়াতে-কমাতে পারেন না। মূলত ঢাকার মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে খাতুনগঞ্জেও দাম বাড়ে। এখন সরকারের উচিত রোজায় ঢাকার মিলগুলো থেকে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। এ জন্য প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রম্নপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে তারা নিজেদের মিলে পরিশোধন করে বাজারজাত করে। চিনি নিয়ে হতে পারে কারসাজি : চিনির গুদামে আগুন লাগার ঘটনায় অসাধু ব্যবসায়ীরা চিনি নিয়ে কারসাজি করতে পারে বলে মনে করেন এস আলম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ। তিনি বলেন, 'আমাদের একটি গোডাউনে আগুনে লেগে চিনির কাঁচামাল পুড়ে গেছে। এগুলো অপরিশোধিত চিনি ছিল। কিন্তু এসবকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দুই-একদিন চিনি নিয়ে কারসাজি করতে পারেন।' রাজারে সরবরাহ করার জন্য চিনির পর্যাপ্ত স্টক রয়েছে উলেস্নখ করে তিনি জানান, দুই-একদিনের মধ্যে ফের উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, 'আমাদের শুধু একটা গোডাউনে আগুন লেগেছে। সেটিতে ক্ষয়ক্ষতি হলেও পাশে আরও গোডাউন রয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি মজুত রয়েছে। ৬-৭ লাখ টন চিনি পাইপলাইনে রয়েছে। আগুন নিয়ে সমালোচনা এস আলম গ্রম্নপের দুটি প্রতিষ্ঠানে পরপর বড় দুটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা দাগ কেটেছে চট্টগ্রামের মানুষের মনে। অগ্নিকান্ডের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসন্ন রোজা ঘিরে চিনির বাজার নিয়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা। এর মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বক্তব্যকে সামনে নিয়ে আসছেন অনেকে। তিনি বলেছেন, আগুনের ঘটনায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে দুই-একদিন চিনি নিয়ে কারসাজি করতে পারে। আমাদের কাছে সরবরাহ করার জন্য চিনির পর্যাপ্ত স্টক রয়েছে। দুই-একদিন পর আমাদের উৎপাদন শুরু হলে অসাধুদের খেলা পন্ড হয়ে যাবে। প্রশ্ন উঠেছে, এই আগুন কী তাহলে কোন ষড়যন্ত্র, নাকি নাশকতা? নাকি ব্যাংক ঋণ থেকে রেহাই পাওয়ার কোন কৌশল বা কারসাজি। আগুনে বীমাসুবিধা পাওয়ার কথাও রটেছে। তবে সব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে এস আলম গ্রম্নপের গ্রম্নপের জেনারেল ম্যানেজার (জিমএম-করপোরেট) মোহাম্মদ আকতার হোসেন বলেন, এ জাতীয় প্রশ্নের দিকে আমরা এখন যেতে চাচ্ছি না। কেউ ষড়যন্ত্র করেছে কিনা, নাকি নাশকতা করেছে, সে ধরনের কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে এখন কথা বলতে চাই না। আর আমরা মানসিকভাবে সেরকম প্রস্তুতও নই এই মুহূর্তে। আপনারা সরেজমিন আছেন, আমাদের কোনো লিকেজ আছে কিনা দেখুন? আগুনের সূত্রপাত নিয়ে রহস্য সোমবার লাগা আগুন এখনো জ্বলছে বলে জানানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুদামের ভেতরে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। এ কারণে আগুনে ক্ষতির পরিমাণও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আগুন কিভাবে লেগেছে তাও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি যা করল অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে সোমবার রাতে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা বলেন, 'বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এস আলম সুগার মিলে যতটুকু ফায়ার সেফটি প্রয়োজন ততটুকু ছিল না। ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে এখনো জ্বলছে আগুন। তাপমাত্রা ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ভেতরে প্রবেশের কোনো জোঁ নেই। বাইরে থেকে ফায়ার এক্সিটিংগুইসার বল আর পানি নিক্ষেপ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে।' গোডাউনের ভেতরে থাকা অপরিশোধিত চিনি পুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া আঠালো আস্তরণ আর তাপ ভোগাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। চিনির কাঁচামালগুলো দাহ্য পদার্থ। এসব না সরানো পর্যন্ত আগুন জ্বলতে থাকবে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে অগ্নিনির্বাপক রোবট লুফ-৬০ ব্যবহার করা হচ্ছে। আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও দুই দিন লেগে যেতে পারে।