প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর পরামর্শ চুক্তির পাইপলাইনে ১০ বিলিয়ন ডলার
বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রম্নতি বাড়ছে
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
এম সাইফুল
চলমান ডলার সংকটের মধ্যে আশা জাগাচ্ছে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রম্নতি। বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রম্নতি বাড়ার পাশাপাশি নতুন ঋণ চুক্তির জন্য পাইপলাইনে অপেক্ষায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে এসব প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৮টি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ চুক্তির জন্য পাইপলাইনে রয়েছে। এর পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ প্রতিশ্রম্নতিও বেড়েছে ৩০৬.১ শতাংশ। এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে অর্থছাড় পিছিয়ে যায়। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে।
ইআরডির তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বৈদেশিক অর্থছাড় হয়েছে ৪৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। যেখানে একই অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এসেছিল ৪০৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সেই হিসেবে শুধু জানুয়ারিতে দাতা সংস্থাগুলো অর্থছাড় করেছে ৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে অর্থসহায়তার প্রতিশ্রম্নতি বাড়াচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো। ইআরডির তথ্য বলছে, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া গেছে ৭১৭ কোটি ২১ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় প্রতিশ্রম্নতি ছিল মাত্র ১৭৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরের ব্যবধানে প্রতিশ্রম্নতি বেড়েছে ৫৪০ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া গেছে এডিবির পক্ষ থেকে। সংস্থাটি ২৬২ কোটি দুই লাখ ডলারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানের কাছ থেকে প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া গেছে ২০২ কোটি ৬ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রম্নতি। তবে অর্থছাড় করলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে কোনো প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া যায়নি।
এদিকে, প্রতিশ্রম্নতির পাশাপাশি অর্থছাড়েও এগিয়ে এডিবি। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১২৪ কোটি ১১ লাখ ডলার অর্থছাড় করেছে সংস্থাটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থছাড় করেছে জাপান। দেশটির উন্নয়ন সংস্থা থেকে অর্থ এসেছে ৮৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ এসেছে ৭৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
একই সময় ৫৮ কোটি ৭৭ লাখ ডলার দিয়েছে রাশিয়া, আর চীন দিয়ে ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এ ছাড়া ভারত ১৬ কোটি ৯৬ লাখ এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এসেছে। বাকি ৩৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার অর্থছাড় করেছে অন্যান্য বিভিন্ন দাতা সংস্থা।
এদিকে খরচ না হলে অর্থ ছাড় করে না দাতা দেশ বা সংস্থাগুলো। তাই প্রকল্প বাস্তবায়ন হার আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অনেক প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা বাড়ছে। কিন্তু তা খরচ করা যাচ্ছে না। পাইপলাইনে তাই প্রতিদিনই জমছে বিপুল পরিমাণ প্রতিশ্রম্নত সহায়তার অর্থ। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ৫ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।
এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকট কাটাতে পাইপলাইনের অর্থ ব্যবহারে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নতুন সকারের প্রথম একনেক সভায়ই নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, বৈদেশিক ঋণ আছে এমন প্রকল্পের গতি বাড়াতে হবে।
ইআরডির তথ্যমতে, বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রম্নতি ও অর্থছাড় বাড়লেও ঋণ পরিশোধের চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বিদেশি সহায়তার আকার দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনে ছিল ৪৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থবছরে বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান মিলে বিদেশি সহায়তায় ছাড় হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তা ছিল ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা অর্থবছর শেষে কমে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাইপলাইনের অর্থ আরও কমে যায়। পাইপলাইনে সব থেকে বেশি ঋণ ও অনুদান পড়ে আছে এডিবির ২.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পরই রয়েছে আমেরিকা-জাপানের কাছে ২.৪১ বিলিয়ন ঋণ। বিশ্বব্যাংকের কাছে পড়ে আছে ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার। ভারত ও চীনের কাছে আছে ২.১৮ বিলিয়ন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে ১.৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ পড়ে আছে। ৮টি বড় উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ১০.৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রয়েছে পাইপলাইনে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ ব্যয়ে দাতাদের নানান শর্ত পরিপালনের পাশাপাশি শতভাগ স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা থাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এতে নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নে অপচয়, অপব্যবহার আর দুর্নীতির সুযোগ থাকে কম, যা অর্থ ব্যয় না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। অপরদিকে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেশীয় অর্থায়নে। কারণ এখানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা তুলনামূলক অনেক কম। দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ থাকে বেশি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক ঋণের বিভিন্ন চুক্তির নানা নিয়ম-কানুন মানতে হয়। কেনাকাটা করতে গেলে ধাপে ধাপে দাতা সংস্থার সম্মতি নিতে হয়। একটি প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ-সংক্রান্ত কাজে ৩-৪ বার তাদের কাছে যেতে হয়। অর্থছাড়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এ কারণেই বৈদেশিক সহায়তার কাজে অনীহা প্রকল্প কর্মকর্তাদের।
তাই অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পাইপলাইনের অর্থব্যয় বাড়ানো এ সময় অত্যন্ত জরুরি। কেননা ডলার সংকট মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী বা দাতা সংস্থাগুলোর অর্থছাড় পেতে হলে বেশকিছু প্রক্রিয়া পরিপালন করতে হয়। উন্নয়ন সহযোগীর অনেক শর্ত যুক্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে অর্থ পেতে হয়। এজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা বাড়াতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প সরকার চাইলে দেরি করেও বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পের ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। যেহেতু দেশে ডলার সংকট আছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন বাড়লে ঋণছাড় বাড়বে। এতে সংকট কমে আসবে।