চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা এলাকায় এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের গুদামে লাগা আগুন এখনো নেভেনি। দাহ্য পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। পুরোপুরি নিভাতে আরও তিনদিন লেগে যেতে পারে। মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এসব তথ্য জানান চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
এদিকে, এ ঘটনায় চিনির বাজারে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে শিল্প গ্রম্নপটি। এস আলম গ্রম্নপের জিএম (কর্মাশিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, এটা নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে প্রভাব পড়বে না। আমাদের এখনো ১০-১৫ দিনের মতো ফিনশড (পরিশোধিত) চিনি হাতে আছে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এমডি আবদুল মালেক বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যতটুকু ফায়ার সেফটি প্রয়োজন ততটুকু এস আলম সুগার মিলে ছিল না। বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফায়ার সেফটি আরও বেশি ভালো থাকার দরকার ছিল।
একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, চিনির কাঁচামালগুলো দাহ্য পদার্থ। সেগুলো না সরানো পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব নয়। ফলে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করতে তিন দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, আগুন নির্বাপণে অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়েছে। এখানে রিজার্ভভারগুলো আরও কাছে থাকলে ভালো হতো। যে রিজার্ভারটি কাছে পেয়েছি তা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে এখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট দরকার। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো থাকলে এত বেগ পেতে হতো না। আগুন নেভাতে আরও সহজ হতো। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, গোডাউনের ভেতরে ১২০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। কারণ আগুনের তাপমাত্রা বেশি। ফলে আগুনে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি আগুন কিভাবে লেগেছে তাও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অগ্নিকান্ডে কোনো হতাহত নেই।
এস আলম গ্রম্নপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক বলেন, গোডাউনে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা এক লাখ টন চিনির কাঁচামাল ছিল। এর পুরোটাই পুড়ে গেছে বলে আশঙ্কা করছি।
এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের পাওয়ার পস্ন্যান্টের সহকারী ফিটার মনির বলেন, গুদামে প্রায় এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি ছিল। এগুলো পুড়ে গেছে। কাছেই পরিশোধিত চিনি আছে আরও কয়েক লাখ টন।
তিনি জানান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও থাইল্যান্ড থেকে চিনির কাঁচামাল এনে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলসের দুটি পস্ন্যান্টে পরিশোধন করা হয়। এর মধ্যে পস্ন্যান্ট-১ এর উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৯০০ টন। পস্ন্যান্ট-২ এর উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ টন। থাইল্যান্ড এবং ফ্রান্সের প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তায় কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, সোমবার বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রম্নপের এই চিনিকলের একটি গুদামে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। বিকাল ৪টার দিকে খবর পেয়ে শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট, পরে আরও ৫টি ইউনিটসহ মোট ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবু আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় যুক্ত হয় আরও ৭টি ইউনিট। সবমিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট কাজ করে।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত জানান, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের আগুন নির্বাপণ কাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্য, নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের দুটি টিম, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড,র্ যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সহযোগিতা করছেন।
তবে মঙ্গলবার সকালে আগুন নেভাতে দেখা গেছে শুধু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। এছাড়া, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসায় বেশ কিছু ইউনিট স্টেশনে ফিরে গেছে। বর্তমানে সাতটি ইউনিট কাজ করছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, রাত সাড়ে ১১টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কারখানার ভেতর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আমরা আগুন নির্বাপণে কাজ করছি।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এখনো আগুন জ্বলছে। তবে তীব্রতা কমে এসেছে।
এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেস এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল পস্ন্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা। কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।
প্রভাব 'পড়বে না' চিনির বাজারে: এস আলম গ্রম্নপ
গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার কথা বললেও এ কারণে আসন্ন রোজায় চিনির বাজারে 'কোনো প্রভাব পড়বে না' বলে আশ্বস্ত করতে চাইছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রম্নপ।
মঙ্গলবার দুপুরে পুড়ে যাওয়া গুদাম দেখতে এসে এস আলম গ্রম্নপের জিএম (কর্মাশিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, ক্ষয়ক্ষতি কত তা এখন আমরা বলতে পারছি না। তবে এটা নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে চিনির দামে প্রভাব পড়বে না। আমাদের এখনো ১০-১৫ দিনের মতো ফিনশড (পরিশোধিত) চিনি হাতে আছে।
আকতার হাসান বলেন, 'আশা করি দুয়েক দিনের মধ্যে আমরা আবার বাজারে ফিরে আসব। আমাদের পাইপলাইনে ৬-৭ লাখ টন চিনি আছে। শুধু একটি গোডাউন পুড়েছে। আরও চারটি গোডাউন আছে। বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না।'
তিনি বলেন, যে গুদামে আগুন লেগেছে তাতে এক লাখ টন সুগার ছিল। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়েছিল ওই চিনি।
বাজারে যে প্রভাব পড়বে না, সেটা কীভাবে বোঝা যাচ্ছে জানতে চাইলে এস আলম গ্রম্নপের জিএম (এইচআর) মোহাম্মদ হোসেন বলেন, 'রোজায় সারাদেশে এক লাখ টন চিনি লাগে। শুধু আমাদেরই এর চেয়ে অনেক বেশি চিনি আছে। সুগারের একটা গুদাম জ্বলেছে। তিনটা অক্ষত আছে। আরেকটা গুদাম ফিনিশড সুগারের, সেটাও অক্ষত আছে।
'আমাদের প্রায় ২৫ হাজার টন পরিশোধিত চিনি রেডি আছে। সেটা ১০-১৫ দিনের মতো চলবে (ফিনিশড গুড)। আগুনের কারণে গতকাল থেকে বাজারে ডেলিভারি বন্ধ। আশা করি দুয়েক দিনের মধ্যে আবার বাজারে চিনি দিতে পারব।'