অমর একুশে বইমেলার আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা নেমেছে শনিবার। এদিন ছিল এবারের ৩১ দিনের মেলার শেষ দিন। এবারের বইমেলা একুশের রক্তপলাশের সঙ্গে যুক্ত হয় মার্চের চেতনার রংয়ে। শনিবার মেলায় ছিল দর্শনার্থী ঠাঁসা। বইমেলা ২৮ দিনের হলেও প্রতি চার বছর পর লিপ ইয়ারের কারণে হয় ২৯ দিনের। তবে এবার ২৯তম দিনটি বৃহস্পতিবার হওয়ায় প্রকাশকদের দাবি ছিল মেলার সময় বাড়িয়ে শুক্রবার-শনিবারও যেন নেওয়া হয়। পরে সেটির অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে এবারের মেলা গড়ায় ৩১ দিনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেলের কারণে এ বছর শুরু থেকেই বইপ্রেমীদের ভিড়ে জমজমাট ছিল মেলা।
তবে মেলার শেষ দিন শনিবার অন্যান্য দিনের চেয়ে শেষবেলায় দর্শনার্থী কম থাকলেও পাঠকদের সমাগম ছিল। স্টলে স্টলে পাঠকদের ভিড় দেখা গেলেও দর্শনার্থীদের সংখ্যা কম দেখা গেছে। শেষবেলায় বইপ্রেমীরা খুঁজে খুঁজে বই কিনছেন। অধিকাংশ পাঠককে হাতে বই নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। খালি হাতে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হননি পাঠকরা।
এদিকে মেলার শেষ দিন হওয়ায় বই গোছাতে দেখা গেছে বিক্রয়কর্মীদের। প্রদর্শনী থেকে বইগুলো প্যাকেজিং করে বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তারা জানান, মেলায় দর্শনার্থী কম হলেও বেচাকেনা ভালো। যারা স্টলে এসেছেন, তাদের ৯০ শতাংশই বই কিনছেন।
শনিবার ছুটির দিন বেলা ১১টায় খুলে দেওয়া হয় মেলার দুয়ার। শিশুপ্রহরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলেও এদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে মেলায় ঢুকে শিশুরা সিসিমপুরের ইকরি, হালুম, সিকু-টুকটুকিদের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। ঘুরে ঘুরে বইও কিনেছে অনেকে। মূলত দুপুরের পর থেকে লোকসমাগম বাড়ে। শেষ দিনে পছন্দের বইটি খুঁজে নিতে মেলায় ঢুঁ দেন বইপ্রেমীরা। আর শেষবেলায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মেলা।
অনুভব প্রকাশনীর প্রকাশক তুষার প্রসূন বলেন, 'মেলার সময় বাড়ানোর কারণে শুক্রবার থেকে ভালো বিক্রি হয়েছে। বই কেনেননি এমন পাঠক দেখিনি। প্রবন্ধ, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাস্থ্যবিষয়ক বই বেশি বেচাকেনা হয়েছে।'
দর্শনার্থী হাসান জামান বলেন, 'মাসজুড়ে ভালো বইয়ের সংখ্যা খুবই কম পেয়েছি। এখনো আগের ফিকশনগুলোই চলছে। ফেসবুকে যা দেখি, কিন্তু এখন সব লেখক সিজনাল। মেলা উপলক্ষে বই লিখেন ভাইরাল হওয়ার জন্য। পরিশ্রম করে ভালো কোনো নন-ফিকশন বই লিখছেন না তারা।'
এবারের স্টল সংখ্যাও ছিল বেশি
এবারের মেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। মেলায় ৩৭টি (একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি) প্যাভিলিয়ন ছিল। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে প্রায় ১৭০টি লিটলম্যাগ স্টল বরাদ্দ পায়।
খাবারের দোকান নিয়ে সমালোচনা
বিগত বছরের মতো এবারও মেলায় পাঠক-দর্শনার্থী-বিক্রয়কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সুবিধার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পাশে খাবারের স্টলের জন্য বরাদ্দ দেয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে মোট ২১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ছিল ফুচকা, আইসক্রিম ও কফি শপ। বইমেলায় মাসজুড়ে এখানের কাচ্চি-বিরিয়ানির দোকান নিয়েও সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। কেউ কেউ বলেছেন, মাত্র কয়েকঘণ্টার এই মেলায় কাচ্চি-বিরিয়ানির মতো ভারী খাবারের স্টল দিয়ে মেলার পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। মেলার শেষ দিন শনিবার খাবার ব্যবসায়ীরা কেমন ব্যবসা করলেন- খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, এই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ একাধিক স্টলেরও মালিক। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, মাসব্যাপী মেলায় স্টলগুলোতে দৈনিক গড়ে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা। তবে এই বিক্রি
সন্তোষজনক নয় বলে দাবি তাদের। লাভ হওয়া নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দোকানীদের কেউ কেউ।
বইয়ের মান নিয়ে সংশয়
অমর একুশে বইমেলা সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে প্রাণের মেলা হিসেবে স্বীকৃত হলেও মেলায় প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ে প্রতিবছরই তুঙ্গে ওঠে আলোচনা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে (২০২০-২০২৪) বইমেলায় নতুন কবিতার বই এসেছে ৫ হাজার ৮০২টি। যেখানে মোট বই এসেছে ১৭হাজার ৭৯৬টি। অর্থাৎ কবিতার বই মোট বইয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অনেকে বলেন, শুধু কবিতার বই নয়; মানহীন অন্য বইয়েও সয়লাব মেলা। বইয়ের গেটাপ-মেকাপ নজরকাড়া হলেও ভেতরে অসংখ্য ভুল। অশুদ্ধ বাক্য এবং চিন্তার সাম্য নেই। আবার যারা এসব বই প্রকাশ করছেন, তাদের নেই কোনো সম্পাদনা পরিষদ। অসম্পাদিত এসব বই পাঠকের কতটুকু উপকারে আসবে, পাঠক কী শিখবে, কতটুকু শিখবে- তা নিয়েও সংশয়ের কথা জানিয়েছেন অনেকে।
সমাপনী অনুষ্ঠান
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগ জানায়, এবারের বইমেলায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকার বই।
বিকাল ৫টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন একাডেমির উপ-পরিচালক ড. সাহেদ মন্তাজ। প্রধান অতিথি ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। এ ছাড়া সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম নাহিদ ইজাহার খান, সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন- বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪
সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশ-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪; ২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত একুশ শতকে বাংলাদেশ : শিক্ষার রূপান্তর গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, মঈন আহমেদ রচিত যাত্রাতিহাস : বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত কিলো ফ্লাইট প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস-কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ এবং ২০২৩ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খি-কে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হয়।
এ ছাড়া ২০২৪ সালের বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট) এবং বেঙ্গল বুকস (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাহাদাৎ হোসেন এবং উপ-পরিচালক সায়েরা হাবীব।