মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বস্নু-ইকোনমির ভান্ডার টুনা মাছ যোগ হচ্ছে রপ্তানি খাতে

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বস্নু-ইকোনমির ভান্ডার টুনা মাছ যোগ হচ্ছে রপ্তানি খাতে

বিশ্ববাজারে সামুদ্রিক টুনা মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যেখানে এই মাছ রপ্তানি করে প্রতিবেশী দেশ ভারত, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান কোটি কোটি ডলার আয় করছে। এবার সেই রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ থেকেও যোগ হতে চলেছে বস্নু-ইকোনমির ভান্ডার টুনা মাছ।

গভীর সমুদ্র থেকে এই টুনা মাছ ধরতে চীন থেকে আনা হচ্ছে দুটি জাহাজ। যার কার্যক্রম আগামী মার্চ থেকে শুরু হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতিতে বাড়বে রপ্তানি খাতের আয়। সোমবার এমন তথ্য জানান মৎস্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার।

তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে মৎস্য আহরণ সম্ভব হয়। কারণ ১০০ মিটারের বেশি গভীরতায় মাছ শিকারের সক্ষমতা বাংলাদেশি জাহাজগুলোর নেই।

ফলে ওই ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে চারটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করে বাংলাদেশের জাহাজগুলো মাছ শিকার করে। এর বাইরে থেকে যাওয়া বঙ্গোপসাগরের এক্সক্লুইভ ইকোনমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনাসহ পেলাজিক মাছের বিশাল ভান্ডার রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এই ধারণা থেকে টুনা মাছ শিকারের জন্য দেশের ১৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মাছ শিকারের অনুমোদন দেওয়া হয়। যারা নিজেরা জাহাজ কিনে মাছ শিকার করার কথা ছিল। কিন্তু এক-একটি জাহাজে বিশাল বিনিয়োগ এবং সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ না থাকায় দীর্ঘদিনেও কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

টুনা মাছ শিকারের উপযোগী জাহাজ ক্রয় করেনি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর নিজেরাই জাহাজ কিনে টুনা মাছ শিকার এবং জরিপের উদ্যোগ নেয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ৬১ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি জাহাজ কেনাসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ডলার সংকটসহ নানা প্রতিকূলতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এতে তিনটি জাহাজের স্থলে দুটি জাহাজ কেনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চীনের ইউনি মেরিন সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামে কোম্পানি থেকে জাহাজ দুটি কেনা হচ্ছে। তাদের ইয়ার্ডে ইতোমধ্যে একটি জাহাজ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। জাহাজটি আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ওই একটি জাহাজ দিয়েই টুনা মাছ শিকার শুরু করা হবে। দ্বিতীয় জাহাজটির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওই জাহাজটি পৌঁছালে সেটিকেও গভীর সাগরে মাছ শিকারে পাঠানো হবে। গভীর সাগরে টুনা মাছ শিকারের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩০ জন ক্রু নিয়োগ দেওয়া ও প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে সাগরের দুশ মিটার গভীরে টুনাসহ অন্যান্য মাছ শিকারের জন্য জাহাজ দুটি পাঠানো হবে। বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাদের উৎসাহিত করতেই মূলত সরকার এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের জাহাজ টুনা মাছ শিকারে সফল হলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মৎস্য আহরণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, টুনা মাছ শিকারের যে উদ্যোগ তাতে এক-একটি প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু কী পরিমাণ মাছ আছে বা রিটার্ন কেমন হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। তাই এই খাতে বিনিয়োগে কোনো প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসেনি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের সাউথ প্যাচেস, সাউথ অফ সাউথ প্যাচেস, মিডল গ্রাউন্ড এবং সোয়াচ অফ নোগ্রাউন্ড এই চারটি অঞ্চলে মাছ শিকার করা হয়। এসব গ্রাউন্ডে মাছ শিকারের জন্য যেতে উপকূল থেকে কমপক্ষে ১০০ নটিক্যাল মাইল পাড়ি দিতে হয়। টুনা ফিশ শিকার করতে আমাদের কমপক্ষে ৩৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে যেতে হবে।

এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ভারত এবং শ্রীলংকার কাছাকাছিতে থাকা বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ শিকার করতে যাওয়ার যে সক্ষমতা তা এখনো আমাদের নেই। তিন থেকে চারদিন জাহাজ চালিয়ে ওখানে পৌঁছাতে হবে। এতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন। রিটার্ন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার আগে এত রিস্ক নিতে কোনো বিনিয়োগকারীই রাজি নন। তিনি সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সরকার যদি সফল হয় তাহলে অবশ্যই আমরাও বিনিয়োগে এগিয়ে আসব।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টুনা মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশেও প্রচুর টুনা মাছ আমদানি হয়। তবে তা মাছ আকারে না এসে তা প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানে করে আনা হয়। জাপান এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টুনা মাছের বিশাল বাজার রয়েছে। যা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তান গভীর সাগর থেকে প্রচুর টুনা মাছ শিকার ও বিদেশে রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করে।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বেলাল হায়দার পারভেজ বলেন, বঙ্গোপ সাগরের গভীরে প্রচুর টুনাসহ পেলাজিক জাতীয় মাছের মজুদের সম্ভাবনা রয়েছে। বস্নু-ইকোনমি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের এ উদ্যোগ বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

উলেস্নখ্য, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির ২৬৩টি ফিশিং ভ্যাসেল রয়েছে। এর বাইরে ৭০ হাজারের মতো ট্রলার ও নৌকাও বঙ্গোপসাগরের ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ শিকার করে। এসব জাহাজ এবং নৌকা বছরে ৬ লাখ টনেরও বেশি মাছ শিকার করে। বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলে ৪৭৬ প্রজাতির মাছ ও ৩৯ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে