২০০০ সালের নভেম্বর মাসে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা ফয়সাল আনোয়ার। বছর পার হয়ে গেলেও এখনও স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড হাতে পাননি তিনি।
চার দফা তারিখ পরিবর্তনের পর গত ১৯ ফেব্রম্নয়ারি চট্টগ্রামের নতুন পাড়া এলাকায় অবস্থিত বিআরটিএ মেট্টো-২ ও জেলা অফিসে গেলে কর্মকর্তারা আরও দুই মাস সময় বাড়িয়ে দেন বলে জানান ফয়সল আনোয়ার।
একই সময় বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্রো-১ ও জেলা কার্যালয়ে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেন চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশর এলাকার আমজাদ হোসেন। তিনি ওমানের মাস্কাটে যাবেন ড্রাইভিং ভিসা নিয়ে। লাইসেন্স সরবরাহের যে তারিখ ছিল সেটি পেরিয়ে গেছে গত বছর অক্টোবর মাসে।
এরই মধ্যে দুই দফা বিআরটিএ কার্যালয়ে যোগাযোগ করলেও কবে স্মার্ট কার্ড পাবেন তিনি সে বিষয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাননি বলে জানান। শুধু চট্টগ্রামের এ দুই ব্যক্তি নন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে পুরো চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য যুবক বিআরটিএ কার্যালয়ে মাসের পর মাস ঘুরছেন।
তাদের প্রশ্ন, কবে নাগাদ মিলবে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। কারও প্রশ্ন, কখন যাব বিদেশ? আবার কারও প্রশ্ন, পরিবারের বোঝা হয়ে থাকব আর কতকাল? এর মধ্যে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা রায়হান উদ্দিন বলেন, সৌদি আরব যাব। স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড নিতে হবে। না হলে ড্রাইভিং করতে পারব না। এখন আবেদনের পর বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ যে কাগজপত্র দিয়েছে, সেগুলো দিয়ে সৌদি আরবে ড্রাইভিং করা যাবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের লাইসেন্স নিয়ে সৌদি আরবে ড্রাইভিং করা যায় না। তবে বাংলাদেশি লাইসেন্স নিতে হবে। আর সেখানে গিয়ে আবার পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সৌদি লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন- ভিসা পেয়েছি আগে, লাইসেন্স পেলে বিদেশে যাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু বিআরটিএ আমাকে আটকে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল হোসেন আবেদন করেছেন গত বছরের জুন মাসে। ডিসেম্বর মাসে নবায়নকৃত স্মার্ট কার্ড পাবেন বলে লেখা হয়েছে আবেদনে। কিন্তু জানুয়ারি মাস শেষ হলেও তিনি কার্ড পাননি। এরই মধ্যে তিনি দুই দফা সিএমপির ট্রাফিক পুলিশের তলস্নাশির মুখে পড়েছেন। প্রথমবার সার্জেন্টকে বুঝিয়ে বলার পর তিনি গাড়ির অন্য কাগজপত্র যাচাই করে ছেড়ে দেন।
কিন্তু ৭ ফেব্রম্নয়ারি দ্বিতীয় দফা ট্রাফিক পুলিশের তলস্নাশির মুখে পড়ে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তাকে। তাই বাধ্য হয়ে
৯ ফেব্রম্নয়ারি বিআরটিএ অফিসে যান স্মার্ট কার্ডের জন্য। সেখান থেকে জানানো হয়, কার্ড প্রস্তুত হয়ে ঢাকা থেকে আসেনি। কার্ড প্রস্তুত হলে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হবে। বার্তা পাওয়ার পর কার্ড সংগ্রহের জন্য বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে যেতে বলা হয় তাকে। একই সঙ্গে তার আবেদনে কার্ড সরবরাহের মেয়াদ আরও ছয় মাস মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করতে না পেরে গ্রাহকদের চাপে রয়েছেন বলে জানান বিআরটিএর কর্মকর্তারা। বিআরটিএর লাইসেন্স শাখার কর্মকর্তা ওমর ফারুক জানান, গত এক বছরে মেট্রো কার্যালয়ে আবেদন পড়েছে ১৯ হাজার ৫৪টি। আর জেলা কার্যালয়ে ৯ হাজার ৪৩৬টিসহ মোট ২৮ হাজার ৪৯০টি আবেদন পড়ে আছে। যাদের আবেদনের মেয়াদ ছয় মাস পেরিয়ে গেছে বা এক বছর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কার্ড পাননি তারা।
তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনেই স্মার্ট কার্ডের জন্য আবেদনকারীরা বিআরটিএ কার্যালয়ে এসে হা-হুঁতাশ করছেন। কেউ কেউ রেগে গিয়ে নানা কটুকথাও শুনাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নেই। ঢাকা থেকে স্মার্ট কার্ড না পাঠালে আমরা কোথা থেকে দেব।
তিনি বলেন, সারাদেশে একই অবস্থা। চলতি বছর গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে হলে অন্তত ২৭ লাখ কার্ড প্রয়োজন। অথচ গত সাড়ে তিন বছরে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাত্র ১৬ লাখ কার্ড পেয়েছে বিআরটিএ।
বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্ট কার্ড তৈরির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিআরটিএ। চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে মাত্র ১৬ লাখের মতো।
চুক্তির দিন থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। এই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা আছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী কার্ড না পাওয়ায় গ্রাহকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না বিআরটিএ।
মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের মানবসম্পদ বিষয়ক ব্যবস্থাপক আশরাফ বিন মুস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, এতদিন ডলার সংকটের কারণে চাহিদামতো কার্ড সরবরাহ করা যায়নি। মাদ্রাজের কারখানায় কার্ড প্রস্তুত হয়ে স্তূপাকারে পড়ে আছে। এই কার্ড দ্রম্নত ডেলিভারি দিতে না পারলে প্রতিষ্ঠানেরই বেশি ক্ষতি। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ভারত থেকে কার্ড আমদানি কঠিন করা হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছোট আকারে ৫০ হাজার লটে কিছু কার্ড এনে সরবরাহ করা হয়েছে।
আশার বাণী শুনিয়ে তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহেই পাঁচ লাখ কার্ড আমদানির ঋণপত্র (এলসি) অনুমোদন পাওয়া গেছে। আশা করছি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে ধাপে ধাপে পাঁচ লাখ কার্ড আমদানিপূর্বক বিআরটিএ-কে সরবরাহ করা যাবে। এই পাঁচ লাখ কার্ড সরবরাহ করা গেলে সংকট অনেকাংশেই কমে আসবে। এরপর প্রতি লটে দুই লাখ করে কার্ড সরবরাহের প্রস্তুতি রয়েছে কোম্পানির।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির কাছে এখন কোনো কার্ড নেই। তারা জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে কার্ড খালাস করতে পারছে না। চুক্তির সময় ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন পৌঁছেছে ১২৫ টাকায়। চুক্তি অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটি কখনোই ঠিকভাবে কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি আমাদের।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) রায়হানা আক্তার উর্থী বলেন, কার্ড নিয়ে যে সমস্যা, তা বৈশ্বিক সমস্যার একটি অংশ। তবে দেশে গাড়ি চালানোর জন্য এখন বিআরটিএ থেকে ই-লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। কার্ডের এই সমস্যা দ্রম্নতই কেটে যাবে। বিমানবন্দরে কিছু কার্ড এসেছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই এগুলো ছাড় পাবে।