'কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।/মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর/আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।' লাইন ক'টি শুনলেই মনে পড়ে বিখ্যাত 'আযান' কবিতাটির কথা। যার রচয়িতা মহাকবি কায়কোবাদ। আজ ২৫ ফেব্রম্নয়ারি এই মহাকবির ১৬৭তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৮৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক অবদানের জন্য মহাকবি কায়কোবাদ মানুষের কাছে সমাদৃত হলেও তার জন্মস্থান ঢাকার নবাবগঞ্জ কবির স্মৃতিচিহ্ন বলতে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যেটুকু আছে তা সংরক্ষণেরও কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের।
মহাকবি কায়কোবাদকে কেউ কেউ বলে থাকেন মুন্সী কায়কোবাদ। অবশ্য কবির প্রকৃত নাম মুহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী। নবাবগঞ্জের আগলা ইউনিয়নের আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতা শাহামাতুলস্নাহ আল কোরেশী ছিলেন ঢাকা জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী। কবি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়াশোনা করেন। পিতার অকালমৃতু্যর পর ঢাকা মাদ্রাসায় (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। তবে পরীক্ষা না দিয়ে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। যেখানে তিনি অবসর নেওয়া পর্যন্ত কাজ করেছেন।
শনিবার আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, সেখানে মহাকবির কিছুই আর নেই। কবির বংশধররা জায়গা-জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। তবে তার জন্মস্থানে প্রবেশের আগেই চোখে পড়ে মহাকবি কায়কোবাদের নামে স্থাপিত বিদ্যালয়। এর পাশেই আছে কায়কোবাদের কাজ করা পোস্ট অফিসটি। এই অফিসের কাজ চলমান থাকলেও এখানে নেই বিদু্যতের ব্যবস্থা। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশেই একটি ভাঙা ঘর। অনেকে জানালেন, এটিই কায়কোবাদের ঘর। তবে এটিও দখলে রেখেছে 'সমাজ কল্যাণ কেন্দ্র' নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। সাইনবোর্ডে লেখা আছে আগলা-পূর্বপাড়া সমাজ কল্যাণ কেন্দ্রের জমিদাতা মো. নুরুল ইসলাম। জমির স্বত্ব নিয়েও আদালতে মামলা চলছে।
যারা কবির বাড়িতে বসবাস করছেন তারা বলেন, 'আমরা জমি কিনে বাড়িঘর করেছি। আমাদের সব কিছুর দলিল আছে। সরকার যদি মহাকবির জন্য যদি কিছু করে, তাহলে আমাদের পুনর্বাসন করে দিলে আমরা তার বাড়িঘর ছাড়তে রাজি আছি। আমরাও চাই মহাকবি আমাদের থেকে শুরু করে পরের জন্মের মাঝে বেঁচে থাকুক।'
এই গ্রামে আছে মহাকবি কায়কোবাদ স্মৃতি সংসদ। সংসদে যুক্ত বিষ্ণুপদ সাহা বলেন, 'কবি কায়কোবাদ নিজ এলাকায় কতটা অবহেলিত তার এলাকায় না এলে কেউ বুঝতে পারবে না। সারা বাংলাদেশের মানুষ তাকে চেনেন, অথচ তার নামে একটা সড়কের নামকরণ করা হয়নি। মহাকবি কায়কোবাদের স্মৃতি বলতে কিছুই নেই। আমরা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। বাড়ি আছে ঠিকই কিন্তু সেখানে কায়কোবাদের উঠানো ঘরও নেই। সবই এখন মানুষের দখলে।'
জনপ্রতিনিধি বা সরকারি উদ্যোগে মহাকবির স্মৃতি ধরে রাখতে নিজ এলাকায় পাঠাগার নির্মাণ করার দাবিও জানান তিনি।
সাবেক দোহার নবাবগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এস এম মোশারফ হোসেন বলেন, 'মহাকবি কায়কোবাদের নাম চিরতরে যাতে না মুছে যায় সে জন্যই প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে তার জীবনী ও কাব্যগ্রন্থগুলো দেওয়া যেতে পারে। তার কাব্যগুলো যদি অনুবাদ ও ভাষা সহজ করে দেওয়া হয় তাহলে বর্তমান প্রজন্ম পড়তে আগ্রহী হবে। তাছাড়া কাব্যগুলো যদি হাতের নাগালের দামে ক্রয় করা যায় তাহলে অনেকে ক্রয় করতে পারবে।'
স্থানীয় বাসিন্দা এস এম পারভেজ লিল্টু জানান, মহাকবি কায়কোবাদ নবাবগঞ্জের গর্ব। বাড়ির সামনে যে মসজিদের আজান শুনে কবি 'আযান' কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি দখলমুক্ত করে কবির নামে একটি পাঠাগার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা জরুরি। এটা হলে কবি সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে।
নবাবগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মামুন দেওয়ান বলেন, 'পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাকবির বাড়ি ও গ্রাম দেখতে লোকজন আসেন। এসে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যান। মহাকবির নামে এখানে কিছুই নেই, তার বাড়িটিও নেই- এটি লজ্জার বিষয়।'
এ বিষয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু বলেন, 'মহাকবি কায়কোবাদের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য সালমান ফজলুর রহমানকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। শিগগিরই তার বাড়ি পুনরুদ্ধার করে কায়কোবাদের নামে দৃশ্যমান, পাঠাগার, জাদুঘরসহ আরও কিছু বানানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তার নামে নবাবগঞ্জের প্রবেশমুখেই 'কায়কোবাদ সেতু' নামে একটি সেতু আছে। আর কায়কোবাদ চত্বরটি এখনো সেই নামেই আছে। অনেকেই বলেন কায়কোবাদ চত্বর আবার অনেকেই বলেন শুধু চৌরঙ্গী।'