কৃষি আবহাওয়া ডিসপেস্ন
চালানোর লোক নেই, কাজে আসছে না বোর্ডগুলো
প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
কৃষকদের আবহাওয়া বিষয়ক নির্ভরযোগ্য তথ্য ও পূর্বাভাস জানাতে জয়পুরহাটের ৩২টি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে স্থাপন করা হয় কৃষি আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড। লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করা এই ডিসপেস্ন বোর্ড এখন কোনো কাজেই আসছে না। ফলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাতে ঘুরিয়ে তথ্য ঠিক করার ম্যানুয়েল সিস্টেম এবং কৃষি কর্মকর্তাদের সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবেই প্রায় অর্ধযুগ ধরে অকেজো পড়ে আছে এসব কৃষি আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড। অথচ বোর্ডগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে একদিকে যেমন এগিয়ে যাবে গ্রামীণ জনপদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি অন্যদিকে আবহাওয়ার আগাম বার্তায় উপকৃত হতেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কৃষি সার্ভিস তথ্য (এআইএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, সরকার ২০১৭ সালে 'কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প' গ্রহণ করে। প্রকল্পের আওতায় দেশের চার হাজার ৫১টি ইউনিয়ন ভবনে কৃষি আবহাওয়া তথ্য বোর্ড ও রেইন গজ, ৪৮৭টি উপজেলায়
কিয়স্ক (একটি ছোট, অস্থায়ী, একক বুথ, যার মধ্যে একটি টাচ স্ক্রিন আছে) স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
এ কাজে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য পাঠানোর জন্য ইন্টারনেট সংযোগসহ ছয় হাজার ৬৬৪টি ট্যাবও সরবরাহ করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১৯ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় ২১২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায়। সেই হিসাবে প্রতিটি ইউনিয়নে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজও দ্রম্নত শেষ হয়।
বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কৃষি মন্ত্রণালয় 'কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প'-এর আওতায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
প্রকল্পের ওই ধরন অনুযায়ী, এটি ডিজিটাল পদ্ধতি মনে হলেও ইউনিয়ন ভবনে ম্যানুয়েল সিস্টেমে স্থাপন করা হয়। আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড আর রেইন গজ বা বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্রটির সঙ্গে কেবল সোলার প্যানেলেরই সংযোগ রয়েছে।
যে সিস্টেমে এটি স্থাপন করা হোক না কেন এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিকূল আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কীভাবে ফসল রক্ষা করা যাবে। তেমনই অনুকূল আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব করাই ছিল এটি স্থাপনের মূল লক্ষ্য।
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দেয়ালে এনালগ পদ্ধতির এসব কৃষি আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড স্থাপন করা হয়। ফলে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে এর প্রাত্যহিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।
তিনি বলেন, 'ডিসপেস্ন বোর্ডটির মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাস ও আলোক ঘণ্টাসহ মোট ১০টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা রাখা হয়।'
এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
নিয়ম অনুযায়ী, এই বোর্ডে ছয় দিনের (তিন দিন আগে ও পরে) হালনাগাদ তথ্য থাকার কথা থাকলেও এটি স্থাপনের পর থেকে তার কোনো কার্যক্রম নাই। এমনকি উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এ বোর্ডের বিষয়ে অবগত নন। ফলে সরকারের এ প্রকল্পটি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ায় কোনো কাজেই আসছে না কৃষি ও কৃষকসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর।
সরেজমিন সদর উপজেলার আমদই ইউনিয়ন পরিষদ ও পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ছাদে গিয়ে দেখা যায়, একটি পস্নাস্টিকের স্বয়ংক্রিয় রেইন গেজ মিটার ও ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ১০ ইঞ্চি প্রস্থের সৌরবিদু্যতের প্যানেল লোহার নাটবল্টু দিয়ে আটকানো থাকলেও সেগুলোর সবই অকেজো।
আবার ভবনের দেওয়ালে একটি করে আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড থাকলেও তা অচল ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এখানে এতটুকু চোখে পড়লেও অনেক ইউনিয়ন ভবনে তাও নাই। শুধু এ দুটি ইউনিয়নেই নয়, একই অবস্থা জেলার ৩২টি ইউনিয়নের সব কটিতেই।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইনসান আলী জানান, এ ব্যাপারে তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই। আবার এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। শুরুর দিকে কিছু দিন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চালানো হলেও কিছু দিন পর প্রায় সব আবহাওয়া ডিসপেস্ন বোর্ড ও বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবই অচল।
একই কথা জানালেন পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জি ইউনিয়নের জীবন কৃষ্ণ সরকার।
এ বিষয়ে কৃষকরা জানান, চাষাবাদের সুবিধার জন্য কৃষকদের আবহাওয়া পূর্বাভাস জানা খুবই জরুরি। কোন মৌসুমে কখন কী ফসল রোপণ করা হবে বা ক্ষেতে সার ও ওষুধ প্রয়োগ করা হবে তা আবহাওয়া পূর্বাভাস থেকে কৃষকরা জানতে পারেন।
আবহাওয়া পূর্বাভাস না জানার কারণে হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বলে জানান তারা।
সদর উপজেলার তাজপুর এলাকার কৃষক নাসির উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, 'ওই বোর্ডটি লাগানোর পর থেকে কোনো কার্যক্রমই নাই। কীসের জন্য এবং কেন লাগানো হয়েছে সেটাও আমরা জানি না। গত সরিষা মৌসুমে সরিষা বোনার পর তুমুল বৃষ্টিতে আমার দেড় বিঘাসহ অনেক সরিষা ক্ষেতে বৃষ্টির পানি জমে পুরা ক্ষেতই নষ্ট হয়ে যায়। যদি আবহাওয়া বোর্ডটি সচল থাকত তাহলে বৃষ্টির পর সরিষা বুনতাম, তাহলে আমাদের এই ক্ষতি হতো না। এসব দুঃখের কথা কাকে কব। ওই আবহাওয়ার বোর্ড দু'পয়সারও কাজে লাগেনি বাবা।'
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাহেলা পারভীন বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে 'কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের আওতায় আবহাওয়া বোর্ড ও রেইন গজ মিটার স্থাপন করা হয়। কিন্তু আবহাওয়া বোর্ডটি ম্যানুয়ালি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তথ্য ঠিক করতে হয় বলে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোনো বাজেট-বরাদ্দ না থাকায় আবহাওয়া বোর্ড ও রেইন গজ মিটারগুলো নষ্টই হয়ে গেছে। সরকারিভাবে এই ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে আরও উন্নত ও ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করা হলে তাতে কৃষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উপকৃত হবেন। সূত্র : বিডিনিউজ