১৬তম দিনে ২৯৮টি নতুন বই
ছুটির দিনে লোকে লোকারণ্য
প্রাণের বইমেলা
প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ফাগুনের আমেজে সকাল থেকেই অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য। এদিন বেলা ১১টায় মেলায় দুয়ার খোলার আগেই টিএসসি ও দোয়েল চত্বর মোড় থেকে জনস্রোত চলছিল বইমেলা অভিমুখে। বইপ্রেমী ক্রেতা-দর্শনার্থীরা সারিবদ্ধ হয়ে মেলায় ঢুকলেও তাতে ভাটা পড়েনি উৎসাহে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইমেলায় তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না। বিক্রেতারা জানান, বেচাবিক্রি জমে উঠেছে। মানুষের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। এদিকে মেলায় দর্শনার্থী বাড়ায় হিমশিম খেতে হয় মেলায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। মেলার অর্ধেক মান পেরিয়ে বিক্রি বাড়ায় খুশি প্রকাশকরা।
পরনে হলুদ শাড়ি, তার সঙ্গে মিল রেখে হাত-কান ও গলায় গয়না, খোঁপায় বাহারি ফুল, মাথায় ফুলের টায়রা- উচ্ছল শিশু-কিশোর-তরুণীরা সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা মাতিয়ে রাখেন বইমেলার বিস্তৃত অঙ্গন। তাদের এক হাতে ছিল নিশ্চিন্ত অভিভাবক বা প্রিয়জনের হাত, অন্য হাতে ছিল প্রিয় লেখকের বই।
শিশুপ্রহরে ফাগুনের আমেজ
ফাগুনের প্রথম শিশুপ্রহর ছিল শুক্রবার। এদিন শিশুপ্রহরে দেখা গেল ফাগুন আমেজ। বসন্তের সাজে এসেছিল শিশুরা। হলদে-লাল শাড়ি পরে শিশুচত্বরে রীতিমতো উড়ে বেড়াচ্ছিল ছোট্ট নবনীতা। বাসন্তি সাজে মা-বাবার সঙ্গে মেলায় এসেছে সে। শিশুচত্বরে আনন্দে মেতে ওঠার পাশাপাশি ঘুরে ঘুরে কয়েকটি বইও কিনেছে। বইমেলার তৃতীয় শিশুপ্রহরে এসে মেয়ের এমন উচ্ছ্বাস দেখে নবনীতার মা-বাবাও খুশি। তারা মেলায় এসেছিলেন রাজধানীর মিরপুর থেকে।
নবনীতার মা সঞ্চিতা বলেন, 'গতবারও মেয়েকে নিয়ে বইমেলায় এসেছিলাম। তখন ওর বয়স ছিল দেড় বছর। আমাদের কোলে চড়েই তখন ঘুরেছে। এবার নিজেই মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে। দেখে খুব ভালো লাগছে।'
দুই বোন রাইসা ও রামিসা মায়ের সঙ্গে মেলায় এসেছে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে। রাইসা পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে আর রামিসা প্রথম শ্রেণিতে। মায়ের সঙ্গে তারা দু'জনও পরেছে হলুদ
পোশাক, মাথায় ফুলের মুকুট। শিশুপ্রহরে স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখে কয়েকটি বই নিছে তারা।
সিলেট থেকে আসা আট-নয়জনের একটি দলকে দেখা গেল বইমেলার শিশুচত্বরে। তাদের মধ্যে ১৩ বছরের বিধি পড়েছে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। এখন কাজ করে চা বাগানে।
রাজশাহী থেকে মা কাজল দাস এসেছিলেন মেয়ে জয়ীকে নিয়ে। কথা প্রসঙ্গে মেয়ে জানালেন, মা খুব পড়ুয়া। অবসরের পুরোটাই তার কাটে নানা ধরনের বই পড়ে। মায়ের জন্য তাই হরিশংকর জলদাস, সেলিনা হোসেনের নতুন বইগুলো খুঁজে বেড়ালেন তিনি।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সানজিদা হোসেনরা এসেছিলেন দল বেঁধে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণের রচনা সমগ্র কিনতে কিনতে সানজিদা বলেন, 'ক্লাসের ফাঁকে মেলায় আসার ফুরসত পাই না। তারপর সেমিনার, অ্যাসাইনমেন্ট তো আছেই। আজ যা একটু বের হতে পেরেছি। আজ বন্ধুরা দল বেঁধে মেলায় চলে এলাম।'
শুভ্র, অনিক ও বাঁধন এসেছেন গাজীপুর থেকে। নতুন আসা বইগুলোর দিকেই তাদের ঝোঁক। তরুণদের দলটি খুঁজছিলেন তরুণদের কথাসাহিত্য, কবিতা ও অনুবাদ।
শুক্রবার ছুটির দিন ১১টায় শুরু হয়ে মেলা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এর মধ্যে বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। অভিভাবক ও স্বজনেরা শিশুদের মেলায় নিয়ে আসেন এই সময়। এর আগে সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব।
শিশুপ্রহরের অন্যতম আকর্ষণ সিসিমপুরের মঞ্চ। সিসিমপুরের জনপ্রিয় চরিত্র হালুম, টুকটুকি, ইকরি, শিকু এবং জুলিয়ার মজার মজার কথা গল্প আর নাচ-গানে শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে।
শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার মাসুম আওয়াল বলেন, 'ফাগুনের প্রথম শিশুপ্রহর, এজন্য নানা রঙে সেজে এসেছে শিশুরা এবং তাদের বাবা-মায়েরা। এটাই মেলার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।'
শিশুদের ছোটকাগজ দোলন সম্পাদক কামাল মোস্তফা বলেন, 'শিশুচত্বরের পাশাপাশি সকালটা পুরো মেলায় দেখেছি শিশুদের বিচরণ। সব স্টলেই অভিভাবকের হাত ধরে শিশুরা ঘুরছে। বইও কিনছে।'
অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'ছুটির দিন এলে মেলা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় যেন। দেখতে দেখতে মেলার অর্ধেকটা সময় কেটে গেল। এখন প্রকাশনীগুলো তাদের ভালো ভালো বইগুলো মেলায় নিয়ে আসবে।'
শুক্রবার বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'স্মরণ : ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হারিসুল হক। আলোচনায় অংশ নেন ফজিলাতুন নেছা মালিক এবং এস এম মোস্তফা জামান। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুলস্নাহ।
এদিকে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানা হয়েছে, শুক্রবার মেলায় সর্বাধিক ২৯৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
শুক্রবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. এম আবদুল আলীম, কথাসাহিত্যিক নাহার মনিকা, কবি স্নিগ্ধা বাউল এবং শিশুসাহিত্যিক অপু বড়ুয়া।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন সুজন বড়ুয়া, মৌলি আজাদ, মাসরুরা লাকী, রিপন আহসান ঋতু এবং মমতাজ রহমান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সোহরাব হোসেন, সাধন কুমার দাশ, দেবাশীষ রুদ্র, ফারহানা পারভীন হক তৃণা এবং নূরননবী শান্ত। এছাড়াও ছিল ফয়জুলস্নাহ সাঈদের নির্দেশনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'শিল্পবৃত্ত' ও 'ঢাকা স্বরকল্পন'-এর পরিবেশনা এবং তাপস মজুমদারের পরিচালনায় 'ইলামিত্র শিল্পী সংঘ'-এর পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী মো. জাকির হোসেন হাওলাদার, শফি মন্ডল, আরতি রানী সেন, দেবোরাহ জান্নাত, নিজাম উদ্দিন লালনী, রাজিয়া সুলতানা এবং মোসা. নিপা আক্তার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন আব্দুল আজিজ (তবলা), মো. বজরুল ইসলাম বিজু, (কী-বোর্ড), মো. হাসান আলী (বাঁশি), মো. হাসান মিয়া (বাংলা ঢোল) এবং শাওন আহমেদ (দোতারা)।
আজকের অনুষ্ঠান
আজ ১৭ ফেব্রম্নয়ারি শনিবার মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'স্মরণ : শহীদ সাবের' এবং 'স্মরণ : পান্না কায়সার' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন যথাক্রমে মনির ইউসুফ এবং মামুন সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশ নেবেন গিয়াস উদ্দিন, সুভাষ সিংহ রায়, রতন সিদ্দিকী এবং শমী কায়সার। সভাপতিত্ব করবেন রামেন্দু মজুমদার।