১৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ৯১টি
বইমেলা জুড়ে বসন্ত আর ভালোবাসার উত্তাপ
প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বীরেন মুখার্জী
ঋতু পরিক্রমায় বুধবার ছিল বসন্তের প্রথম দিন। ঋতুরাজ বসন্তের হাতে-হাত রেখে এদিন ছিল বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। রাজধানীতে কোকিলের কুহু ডাক শোনা যাক বা না যাক, বরাবরের মতোই এদিন সকালে বসন্ত বরণের বাদ্য বেজে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। আর বিকালে বসন্ত দিন ও ভালোবাসার সমবেত উচ্ছ্বাস বকুলতলা ছাপিয়ে পৌঁছে যায় অমর একুশে বইমেলায়।
বুধবার বিকাল ৩টায় মেলার দুয়ার খোলার পরপরই জনসমাগম বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার আগেই মানুষে মানুষে পূর্ণ হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। বইমেলা মুখরিত হয়ে ওঠে হলুদ-বাসন্তী কিংবা লাল শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা যুগলদের পদচারণায়। একদিকে বইয়ের পাতার গন্ধে বসন্তের সুর অন্যদিকে ভালোবাসা দিবসের রঙিন হাওয়া, দুয়ে মিলিয়ে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে ছিল উৎসবের আমেজ। বসন্ত আর ভালোবাসার সুবাসে রঙিন হয়ে ওঠে বইমেলার ১৪তম দিন।
শুধু আগত দর্শনার্থীই নয়, বসন্তের সাজে মেতেছিলেন মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীরাও। বিক্রয়কর্মীদের হলুদ-কমলা-লালসহ নানা রঙের পোশাকের সাজে দেখা গেছে। মেলা প্রাঙ্গণে বইপ্রেমীদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। নারীরা এসেছিলেন খোঁপায় ফুলের মালা, মাথায় ফুলের টায়রা, হাতে রেশমি চুড়ি আর পরনে বাসন্তী রঙের শাড়িতে। অন্যদিকে পুরুষরা রঙিন পাঞ্জাবি-ফতুয়াতে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুভব প্রকাশনীর সামনে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন বন্ধুর সঙ্গে। বসন্তের সাজে মেলায় এসেছিলেন তারা। তাদের একজন জাহাঙ্গীর বলেন, 'পহেলা ফাল্গুনে বন্ধুরা মিলে ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা থেকেই বইমেলায় আসা। মেলায় এসে বসন্তের যে সুবাস তা ভালোভাবে পেলাম। নানা রঙের পোশাকে সবাইকে রঙিন লাগছে। আর আমরা সবাই বই কিনেছি, এর মধ্যে কয়েকজনকে উপহার দেব কয়েকটি বই।'
মেলায় কথা হয় অনুভব প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কবি তুষার প্রসূনের সঙ্গে। বই বিক্রির বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের ভিড়ও বাড়ছে মেলায়। এখন মেলার উপস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। মানুষ ঘুরছে, সঙ্গে বইও কিনছে। সামনে উপস্থিতি আরও বাড়বে আশা করি।'
বসন্ত আর ভালোবাসার দিনে মেলায় এসেছিলেন অনেক লেখকও। কথা হয় তরুণ লেখক হিমেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের প্রথম দিন বলে কথা। মেলায় এবার আমার বই নেই তবুও আসছি প্রায়ই। আজ না এলে এই নান্দনিকতা মিস করতাম।'
এদিকে, বুধবার সকালে ঢাবি চারুকলায় ঋতুরাজ বরণের উৎসব মাতিয়ে তোলেন কণ্ঠ-নৃত্যশিল্পী ও যন্ত্রীরা। সেখানে শামিল হতে এসেছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা, ছিলেন তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ। নারীদের পরনে ছিল বাসন্তী শাড়ি। খোঁপায় বা কব্জিতে জড়ানো ফুলের মালা। ছেলেরাও সেজেছেন রঙিন পাঞ্জাবিতে। অনেকে এসেছিলেন গালে আলপনা এঁকে। আবির খেলায় মেতে ওঠেন কেউ কেউ। এসেছিলেন বিদেশিরাও।
বকুলতলার এই উৎসবের আয়োজন করে 'জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ'। দেশের দশটির বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা অংশ নেন এই আয়োজনে।
প্রতি বছরের মতো এবারও উৎসবের সূচনা হয় যন্ত্রসংগীতের মধ্য দিয়ে। সেতারে 'বসন্ত মুখারী' রাগ বাজিয়ে শোনান শিল্পী জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর একে একে গান, নাচ, আবৃত্তি ও বসন্ত কথনে মেতে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গণ।
বসন্ত কথন পর্বে 'উদযাপন পরিষৎ'-এর সভাপতি সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'বসন্ত উৎসব মূলত মিলনের উৎসব। বসন্ত আমাদের জনজীবনে পালন হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। আমরা এটিকে একটা আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি কেবল। এবার ভালোবাসা দিবসও একই দিনে এসে মিলেছে। দুটি একই রকমের উৎসব। ফলে এ দুই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা বসন্তবরণ করছি।'
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট তার বক্তব্যে কবি শামসুর রাহমান, শিল্পী ওয়াহিদুল হক, অভিনেতা আলী যাকের, আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফসহ প্রয়াত শিল্পীদের স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, 'এই আবাহনের মধ্য দিয়ে আমরা মূলত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, সব মানুষের বাংলাদেশ। ধর্ম-গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমতার এক বাংলাদেশ, সাম্যের বাংলাদেশ গড়ব। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। বসন্তের এই বর্ণিল দু্যতি সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক।'
উৎসবে বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নেন ভাবনা, ধৃতি, নৃত্যম, বহ্নিশিখা, নৃত্যাক্ষ্য, স্পন্দন, কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন নাচের দলের শিল্পীরা। সংগীত পরিবেশন করেন অনিমা মুক্তি গোমেজ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলামসহ অনেকে। আয়োজনে ছিল সাঁওতাল ও চাকমা নাচ।
অনুষ্ঠানে বসন্ত আবাহন করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, আবৃত্তি পরিবেশন করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেছে সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী ও সুরের ধারা।
সকালের অনুষ্ঠান শেষ হয় 'বসন্ত আনন্দ' শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। চারুকলা থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে শোভাযাত্রাটি চারুকলায় ফিরে শেষ হয়। শোভাযাত্রার আগে ছিল 'রাখী বন্ধন' উৎসব।
বসন্ত বরণের বিকালের পর্ব শুরু হয় বিকাল সাড়ে ৩টায় বেঙ্গল পরম্পরার যন্ত্রসংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। পরে গান, নাচসহ নানা পরিবেশনায় অংশ নেবেন শিল্পীরা।
এদিকে, বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অমর একুশে বইমেলার ১৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ৯১টি।
এদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাফাত আলম মিশু। আলোচনায় অংশ নেন সুজাতা হক এবং মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী।
প্রাবন্ধিক বলেন, 'বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল জনমানুষের সামূহিক আন্দোলন-সংগ্রামের পরম্পরাগত বহুমাত্রিক ঘটনাপুঞ্জের একটি দৃশ্যমান রূপ। আর এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা ব্যক্তি থেকে সময়ের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন, ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আশি বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ছিলেন একাধারে মেধাবী ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, লেখক, গীতিকার, সুবক্তা এবং আইনজীবী। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তার বড় পরিচয় তিনি একজন ভাষাসংগ্রামী এবং মুক্তিযোদ্ধা। গাজীউল হক নিজে লেখক ছিলেন, তাই তার জীবনপাঠের ক্ষেত্রে তার রচনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।'
আলোচকরা বলেন, 'ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা গাজীউল হক ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন স্বদেশ, ভাষা ও মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আপসহীনতা, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে কোনো অপশক্তি তাকে আদর্শচু্যত করতে পারেনি। শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও শোষণবিরোধী আন্দোলনে তার সংগ্রামী অভিযাত্রা অব্যাহত ছিল।'
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেন, 'ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক আমৃতু্য তার দুঃসাহসী ও দৃঢ় মানসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসে তার কর্ম ও আদর্শ চিরঅমস্নান হয়ে থাকবে।'
লেখক বলছি মঞ্চ
বুধবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, কবি শাহেদ কায়েস, লেখক ও সংগীতজ্ঞ তানভীর তারেক এবং কথাসাহিত্যিক মাজহার সরকার।
এছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মারুফুল ইসলাম, মাসুদুজ্জামান, ইসমত শিল্পী এবং সাহেদ মন্তাজ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার কলেস্নাল, মাসুদুজ্জামান এবং চৈতালী হালদার। পুঁথিপাঠ করেন মো. শহীদ এবং মো. কুদ্দুস মিয়া। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রফিকুল আলম, খুরশীদ আলম, মামুনুল হক সিদ্দিক, মুর্শিদুদ্দীন আহম্মদ, মো. রেজওয়ানুল হক, কাজী মুয়ীদ শাহরিয়ার সিরাজ জয়, আঞ্জুমান আরা শিমুল, চম্পা বণিক, শরণ বড়ুয়া এবং অনন্যা আচার্য। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন বিশ্বজিৎ সরকার (তবলা), সুমন রেজা খান (কী-বোর্ড), মো. আকবর হোসেন (লিড গিটার), আনোয়ারুল হক (বেস গিটার) এবং মনির হোসেন (অক্টোপ্যাড)।
আজকের অনুষ্ঠান
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'স্মরণ : আবদুল হালিম বয়াতি' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জোবায়ের আবদুলস্নাহ। আলোচনায় অংশ নেবেন শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং মো. নিশানে হালিম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সাইদুর রহমান বয়াতি। মেলা খুলবে যথারীতি বিকাল ৩টায় এবং শেষ হবে রাত ৯টায়।