ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয় অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবছে

প্রায় সোয়া কোটি টাকার হদিস নেই নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসেছে ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয়। এক সময়ের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমে বর্তমানে প্রায় দুইশ'তে এসে ঠেকেছে। প্রধান শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ড আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে লুটপাটের মচ্ছব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সোয়া কোটি টাকার কোনো হদিস মিলছে না। এ নিয়ে রীতিমতো অসন্তোষ বিরাজ করছে। ঘটনাটির তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগে জমা পড়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঢাকার নিউ ইস্কাটন গার্ডেন সড়কে ১০/বি নম্বর বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চালু হয় ১৯৭৪ সালে। ২০১২ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে চলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। দুলাল চন্দ্র চৌধুরী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় স্কুলে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। তিনি নিয়োগ বিধিমালা অমান্য করে স্কুলের আয়া পদে তথ্য গোপন করে একজন নারীকে নিয়োগ দেন। এমনকি ওই আয়াকে এমপিও ভুক্তিতেও সহযোগিতা করেন তিনি। প্রার্থীর প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে ম্যানেজিং কমিটিকে ভুল বুঝিয়ে আয়া নিয়োগ দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সালে ৫ ডিসেম্বর স্কুলটির সহকারী শিক্ষক হুমায়ুন কবির ঢাকার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিতভাবে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষিকার অনৈতিক সম্পর্ক থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেন। অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণাদিও দাখিল করেন। একই বিষয়ে ২০২১ সালের ৬ আগস্ট আবারও অভিযোগ করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অভিভাবক সদস্য কাজী মোশারফ হোসেন। তদন্তে প্রধান শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তারই প্রেক্ষিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তরফ থেকে প্রধান শিক্ষককে শোকজ করা হয়। শোকজের জবাব দেয়ার কথা থাকলেও তা তিনি দেননি বলে জানা গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, স্কুলটির পিছন দিকে ৭টি দোকান রয়েছে। এসব দোকান বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিতে অগ্রিম টাকা নিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কোনো দোকানের ভাড়া মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার নিচে নেই। দোকানের আকার ভেদে প্রতিটি দোকানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা অগ্রিম নিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও তার অনুসারী ম্যানেজিং কমিটির লোকজন। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (শিক্ষা ও আইসিটি) কাছে সাতজন শিক্ষকের স্বাক্ষর করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, দোকানিদের কাছ থেকে দোকান বরাদ্দের অগ্রিম হিসেবে প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ছিল প্রায় ২০ লাখ। এসব টাকা স্কুলটির অগ্রণী ব্যাংক একাউন্টে থাকার কথা ছিল, অথচ একাউন্টে কোনো টাকা নেই। স্কুলটির সিনিয়র শিক্ষক মো. আব্দুলস্নাহ ভুঁইয়া যায়যায়দিনকে বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে স্কুলের আয়া, বেয়ারা বা নিম্নপদে কর্মরতদের দিয়ে প্রধান শিক্ষক কৌশলে খারাপ ব্যবহার করান। যাদের মদদদাতা হিসেবে কাজ করেন স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোকজন। মূলত তারাই প্রধান শিক্ষকের শক্তি। এই শিক্ষক আক্ষেপ করেন বলেন, একজন শিক্ষক হয়ে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করেন। যা তার এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। খারাপ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তিনি নারী বা পুরুষ শিক্ষক পর্যন্ত দেখেন না। একজন প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা কোনো সময়ই এ ধরনের আচরণ আশা করি না। এটি সত্যিই বড় পরিতাপের বিষয়। এসব বিষয়ে স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি শহীদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। মানুষ গড়ার কারিগররা যদি অনৈতিক ও দুর্নীতিতে ডুবে যান, তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কোথায় যায়, এটি বুঝার জন্য বিরাট বড় পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় ১৩ জন অকৃতকার্য হয়েছে। আগে স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬শ'র বেশি। তিনি বলেন, বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ জনে। দিনকে দিন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠানটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, খারাপ আচরণ আর দুর্নীতির কারণে। তার সঙ্গে রয়েছে তারই কিছু নিজস্ব লোকজন। যারা তাকে নানাভাবে দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছেন। যে কারণে সনামধন্য স্কুলটি একপ্রকার ডুবতে বসেছে। এমনকি স্কুল ফান্ডের প্রায় ৬০ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই। নানা অভিযোগ আর অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, স্কুল ফান্ডের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ ও রাজউকের অনুমোদন সাপেক্ষে ভবন তৈরি করার দাবি করা হলেও তিনি অনুমোদনের কোনো কপি দেখাতে পারেননি। শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, টাকা আপাতত নেই, তবে আসতে কতক্ষণ! দোকান বরাদ্দের প্রেক্ষিতে অগ্রিম নেয়া টাকা স্কুলের উন্নয়নে ব্যয় করার দাবি করেন তিনি। যদিও ব্যয়ের কোনো সঠিক প্রমাণাদি দেখাতে পারেননি। এক নারী শিক্ষিকার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে আমাকে শোকজ করা হয়েছিল। শোকজের জবাব দিতেও বলা হয়েছিল। তিনি জবাব দিয়েছেন। এমনকি সেই অভিযোগ থেকে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।' তবে খালাস পাওয়া সংক্রান্ত বোর্ডের বা তদন্ত কমিটির কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। স্কুলের কোনো শিক্ষকের সঙ্গে তিনি খারাপ ব্যবহার করেন না। এমনকি প্রতিষ্ঠানের কাউকে তিনি কোনো শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে প্ররোচিতও করেন না। এ ব্যাপারে ঢাকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, এক সময় স্কুলটির অনেক সুনাম ছিল। বহু পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার ঐহিত্য হারাতে বসেছে। বিষয়টি বোর্ডের নজরে এসেছে। ম্যানেজিং কমিটি ও স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও রয়েছে। এ ব্যাপারে মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগে অভিযোগও জমা পড়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে আইনগত পদক্ষেপ নিতে স্কুল বিভাগের প্রধানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।