আজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতি তার সজীবতাকে নতুন করে মেলে ধরেছে। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে চারদিক। সেই সঙ্গে আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পাশাপাশি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। এই তিন উৎসব ঘিরে রাজধানীতে ফুলের চাহিদা তুঙ্গে উঠেছে। খুচরা ও পাইকারি ফুলের বাজারগুলো এখন জমজমাট অবস্থা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের শুরুর দুই থেকে তিন মাস ফুলের ভরা মৌসুম। বাকি সময়ে ঢিমেতালে বিক্রির পর বিক্রেতাদের চাওয়া থাকে নতুন বছরের শুরু থেকেই যেন চাঙ্গা থাকে ফুলের বাজার। আর ফেব্রম্নয়ারির শুরুতে এটি দাঁড়ায় জমজমাট অবস্থায়। বাজার দাঁড়ায় কোটি-কোটি টাকায়।
মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগের বটতলা ফুলের মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, জমে উঠেছে এখানকার ফুল দোকানগুলো। প্রতিটি দোকানই নানা রকম দেশি-বিদেশি ফুল দিয়ে ভর্তি। বিভিন্ন রঙ ও ধরনের গোলাপ, চন্দ্রমলিস্নকা, গস্ন্যাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা, লিলি, গাঁদা, জিপসি, মাম, ক্যালেন্ডোলা ফুল সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতারা। ফুল দিয়ে তৈরি মালা, মাথার রিং, গাজরাও পাওয়া যাচ্ছে সেসব দোকানে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই ক্রেতাদের ভিড় নেমেছে দোকানগুলোয়। তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ সাজগোজ করে ভিড় জমান ফুল কিনতে। কেউবা প্রিয়জনের জন্য ফুল কিনছেন, কেউবা কিনছেন নিজের জন্য, কেউবা পরিবার আবার কেউ কিনছেন পূজার জন্য। সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরাও আসছেন ফুল মার্কেটে। সব মিলেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিক্রেতারা। প্রায় কারোরই বসে থাকার ফুসরত নেই।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। চাহিদাও রয়েছে বেশ। সব মিলিয়ে সামনের ভালোবাসা দিবসের দিন অনেক ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছেন সবাই। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে অতিরিক্ত ফুলের প্রি-অর্ডারও করে রেখেছেন অনেকে।
শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার বাগান মালিকরা ফুলের দাম বাড়িয়ে রেখেছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। আশা করছি, এবার খুচরা বাজারে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।
ফুলশয্যা নামের খুচরা দোকানের বিক্রেতা জাকারিয়া বলেন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের জন্য আমরা অগ্রিম ফুলের অর্ডার দিয়ে রেখেছি। ভালো মানের গোলাপ ফুল এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভালোবাসা দিবসের দিনে এটা ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হবে। গোলাপি রঙের বিদেশি গোলাপ এখন প্রতি পিস ১০০ টাকা বিক্রি করছি। ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ১৫০ টাকার বেশি বিক্রি হবে।
দিবসকেন্দ্রিক দাম বাড়িয়ে রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাগান মালিকের কাছে আমার এক লাখ টাকার গোলাপ অর্ডার দেওয়া আছে। তারাই দাম বাড়িয়ে রাখছেন। আমরা কী করব বলুন? পাইকারিতে দাম কম থাকলে খুচরা বাজারে কমিয়ে দিতে পারি। কিন্তু পাইকারি যদি বেশি দামে কিনতে হয় তাহলে তো আমাদের কিছুই করার নেই।
এ ছাড়া রজনীগন্ধার স্টিক মানভেদে ২০ থেকে ৮০ টাকা, প্রতিটি গাঁদার মালা ৬০ থেকে ১২০ টাকা, জারবেরা ফুল ৫০ থেকে ১২০ টাকা, অর্কিড স্টিক ৮০ থেকে ১০০ টাকা, গস্নাডিওলাস রঙ ভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
শাহবাগের বটতলার আলাউদ্দিন ফুল ঘরের বিক্রেতা বাদল ইসলাম খোকা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন দিবসে ফুলের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়, যার কারণে দামও একটু বেশি থাকে। তবে এই দাম আমরা ইচ্ছা করে বাড়াই না। চাষি থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রেতা সবাই বেশি দাম রাখে। এর করণে আমাদেরও বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। আর এই একদিন ব্যবসার জন্যই আমরা বসে থাকি। এই তিন দিবস ঘিরে ৩ লাখ টাকার ফুল কিনেছি। আশা করি সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হবে। এবার পরিস্থিতি ভালো, সকাল থেকেই ভালো ক্রেতা রয়েছে।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন মাহমুদা পুষ্পালয়ের স্বত্বাধিকারী ইসলাম হোসেন মন্টু। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম। ফুলের দামও গত বছরের এই দিবসে যা ছিল, তার থেকে কম। পরশু থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ায় এবার অনেকে ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুনে বের হবে না। যার কারণে বেচাকেনা কম। তবে বাজারে এবার ফুলের সংকট নেই। যথেষ্ট পরিমাণ ফুল আছে। যার কারণে বিশেষ দিন হিসেবে দাম এবার তুলনামূলক কম। এক লাখ ২০ হাজার টাকার ফুল কিনেছে, আশা করি ২ লাখ টাকার মতো ব্যবসা হবে।
ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি বাবুল প্রসাদ বলেন, সারা বছর তো এখানে পাইকারি দামে ফুল বিক্রি হয়। ধরেন, প্রতিদিন এখানে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। আর আগামী ১৪ ও ২১ শে ফেব্রম্নয়ারিতে প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি পাইকারিতে ফুল বিক্রি হবে। আর খুচরা বাজার তো আছেই। যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রংপুরসহ মোট ২৪টি জেলা থেকে এখানে ফুল আসে।
তবে অধিকাংশ ক্রেতার অভিযোগ, ফুলের দাম বাড়তি। রোহান আহমেদ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ১৪ ফেব্রম্নয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে এরই মধ্যে ফুলের চাহিদা বেড়েছে। সেজন্য ব্যবসায়ীরাও দাম বেশি চাইছেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। তারা সাধারণ মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন।
সামিনা লুতফা নামের আরেক ক্রেতা বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে ফুলের দাম তিন গুণ বেশি। ভালোবাসা দিবসে ফুলের চাহিদা বেশি হয়ে ওঠে, কারণ এটি ভালোবাসা প্রকাশের উপযুক্ত উপহার। ফুলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার আনন্দ ও মনোমুগ্ধতা বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ঠিক এ সুযোগটি নিচ্ছেন। এটি নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই।
ফুলের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা উচিত উলেস্নখ করে নাহিদ হাসান নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ফেব্রম্নয়ারি মাসে ফুলের চাহিদা বাড়ে। এটি ফুল উৎপাদনেরও সময়। বাজারে ফুলের কোনো ঘাটতি নেই। সেজন্য বিষয়গুলো তদারকি করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা যা খুশি দাম নিচ্ছেন। তাই অতিরিক্ত দাম ঠেকাতে যথাযথ তদারকি প্রয়োজন।
লুবনা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতি বছরই পহেলা ফাল্গুনে সাজগোজ করে বের হই। সেই সাজগোজ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় ফুল। আজকে যেহেতু এদিকে ঘুরতে এসেছি, তাই নিজের জন্য ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ফুলের দাম একটু বেশি, তবে দামাদামি করলে কমেই কেনা যাচ্ছে। আর বিশেষ দিনে বিক্রেতারা দাম একটু বেশি রাখবে এটাই স্বাভাবিক।
ফুল কিনতে এসেছেন একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ম্যানেজার ইসরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিভিন্ন দিবসে ফুলের দাম বেশি থাকে। তবে চাষিরা এর দাম পান না। যে ফুল দোকানে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেই ফুল চাষি হয়তো বিক্রি করেছে মাত্র ১০ টাকায়। এই বিষয়টি দোকান মালিক সমিতির দেখা উচিত।
কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কোনো কিছুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, দামও তখন বাড়ে এটাই স্বাভাবিক। এটা ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা নয়। ফুল তো এমন কোনো জিনিস নয় যে কিনতেই হবে। যার সামর্থ্য আছে, তিনি কিনবেন। যার সামর্থ্য নেই, তিনি কিনবেন না। এটা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখানে দেখার বিষয় কৃত্রিম সংকট হচ্ছে কি না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ফুল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। এটা মননের বিষয়। এটি নিয়ন্ত্রিত কোনো পণ্য নয়। শাহবাগে ফুলের যে দাম রাখা হয়, গুলশানে হয়তো এর থেকে পাঁচগুণ দাম রাখা হয়। তবে কোনো ক্রেতা এই বিষয়ে অভিযোগ জানালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।