পটিয়ার পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের অপহরণ বাণিজ্য
প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
পটিয়ায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আবারও অস্ত্রের মহড়া দিয়ে অপহরণ শুরু করেছেন। তাদের ভয়ে উপজেলার পাহাড়ি এলাকার লোকজন বর্তমানে আতঙ্কে রয়েছে। দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন পাহাড়ে ধরে নিয়ে পরে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় সময় উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, শ্রীমাই পাহাড় ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বোয়ালখালী ও চন্দনাইশ, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মহড়া চলছে বলে স্থানীয় দিনমজুর ও কাঠুরিয়ারা জানান। পাহাড়ে যারা গাছ বাগান, লেবু বাগানসহ দিনমজুরের কাজ করেন এমন লোকজনকে ধরে নিয়ে জিম্মি করে তাদের পরিবার এবং মালিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে পটিয়া, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, দোহাজারি, চন্দনাইশ এলাকার গহিন অরণ্য থেকে এসব সন্ত্রাসীর আনাগোনা বেড়েছে। পটিয়া, বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে কৃষি অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নানা ধরনের ফলমূল থেকে শুরু করে গাছের বাগান সৃজন করে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা ও বাগান মালিকরা। নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন দেশের কয়েকটি শিল্প গ্রম্নপও।
সম্ভাবনাময়ী কৃষি অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এসব পাহাড়ে এখন নতুন আপদ দেখা দিয়েছে পাহাড়ি সীমান্ত এলাকায় অপহরণ বানিজ্য। এসব গহিন পাহাড়ে আস্তানা গেঁড়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। শ্রমিক ও বাগান মালিকদের জিম্মি করে 'মুক্তিপণ আদায় করে চলেছে। গত তিন বছরে অন্তত দুই শতাধিক শ্রমিককে আটকে রেখে কয়েক লাখ টাকার মুক্তিপণ আদায় করেছে সন্ত্রাসীরা। জীবন-জীবিকার তাগিদে যাওয়া নিরীহ শ্রমিকদের পাহাড় এখন আতঙ্ক ও শঙ্কায় পরিণত হয়েছে।
একাধিক বাগান মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পটিয়া, বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে লেবু, পেয়ারা, মাল্টা, লিচু, আম ছাড়াও নানা ধরনের ফলদ বাগান রয়েছে। রয়েছে সেগুন গাছসহ নানা ধরনের গাছের বাগানও। এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা মৌলভিবাজার, পটিয়ার কেলিশহর, রতনপুর, ধলঘাট অংশ এবং রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা এলাকার পাহাড়ি অঞ্চলের দূরত্ব ৬-৮ কিলোমিটার। এর ফলে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালীর বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে একটি সন্ত্রাসী গ্রম্নপ নিয়ন্ত্রণ করছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গহিন পাহাড়ি অঞ্চল।
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ১১ দিনমজুরকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পটিয়ার খরনা ইউনিয়নের লালারখীল এলাকা থেকে ওই ১১ জনকে অপহরণ করা হয়। পরে সেদিন সন্ধ্যায় মুক্তিপণের বিনিময়ে পরিবারের সদস্যরা তাদের মুক্ত করেন বলে জানা গেছে। অপহৃতদের মধ্যে মুন্সি মিয়া, আবদুল আলিম, মোহাম্মদ কাসেম, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ নাসু, মোহাম্মদ সৈয়দের নাম জানা গেছে।
এদিকে, কয়েক দিন আগে পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ সীমান্তের পরিমল পাড়ায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা একজনকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তাকে পুড়িয়ে ফেলেছে বলে জানা গেছে। গহিন ওই এলাকায় বসবাসরত নিহতের পরিবারের সদস্যরদেরও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে তারা এ নিয়ে মুখ খুলছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি।
ওই জনপ্রতিনিধি জানান, গত ৫-৬ দিন আগে বিশেষ পোশাক পরিহিত ৮ জন সন্ত্রাসী পরিমল পাড়ায় গিয়ে টিন মইঘ্যা নামে ওই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে বের করে মাথায় ও শরীরে ৩ রাউন্ড গুলি করে হত্যা করে। এরপর তাকে পুড়িয়ে ফেলে। এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বললে তাদেরও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাহাড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় 'অভয়াশ্রম' গড়ে তুলেছে।
এদিকে, পটিয়ার খরনা লালারখীল এলাকায় অপহরণের পর মুক্তি পাওয়া আহত আবদুল আলীম বলেন, গো-চারণ ভূমিতে গরু নিয়ে গেলে সেখান থেকে তিনিসহ মোট ১১ জনকে অস্ত্রের মুখে আপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এরপর তাদের বেদম মারধর করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণের জন্য মোবাইল ফোনে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের কথামতো অপহৃতদের প্রতিটি পরিবার বিভিন্ন অঙ্কোর চাঁদা দিয়ে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তাদের মুক্ত করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও জিম্মি করার ঘটনায় পাহাড়ের আশপাশের জনবসতির লোকজন আতঙ্কে দিন যাপন করছেন। সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণ ও তাদের চাঁদাবাজি এখন নিত্যদিনের ঘটনা হলেও লোকজন ভয়ে মুখ খুলছেন না এবং থানায়ও যাচ্ছে না। কেউ থানায় গেলে তার পুরো পরিবারকে আবার টার্গেট করে সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ে জমি ও বাগান মালিকরা চাঁদা না দিলে পাহাড়ে যেতে পারছেন না। শ্রমিকরা বাগানে কাজ করতে পারছেন না। পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল লোকজনের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার ত্রি-সীমানায় অবস্থিত চাকমা পাড়াকে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছে।
গত বছরের ১২ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার ১৪ লেবু বাগান শ্রমিক অপহৃত হন। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান সাত শ্রমিক। ৭০ হাজার টাকার মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে জানান অপহৃতরা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করা হয়। একই দিনে বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা থেকেও ১০-১৫ জন অপহৃত হয়েছিলেন।
এ সময় অপহৃত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গহিন অরণ্যের চাইলত্যাছড়ি ঢালাইর মুখ এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করা হয়। পটিয়ার কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভিবাজার, মাঝিরপাড়া ও খিলস্নাপাড়া গ্রামে। এ ঘটনার পর গত বছরের ১৮ এপ্রিল পটিয়া অংশে পুলিশ ও র?্যাব যৌথ অভিযান পরিচালিত হয় পাহাড়ি এলাকায়। কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভীবাজার হয়ে গহিন পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে পুলিশ-র?্যাবের এ অভিযান ছিল অনেকটা নিষ্ফল। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা এলাকার কৃষক ও সাধারণ লোকজনকে অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে সত্যতা পেলেও কয়েক দফায় অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারেননি। প্রায় দুই বছর আগে র?্যাব, পুলিশ ও পটিয়া সীমান্তের বান্দরবানের ডলু ক্যাম্পের সেনাবাহিনীর টিম একই সময় যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেছিল। তবে সে সময় সন্ত্রাসীদের আস্তানা খুঁজে পাননি।
গত বছরের এ সময়ও বোয়ালখালী উপজেলার কড়লডেঙ্গা ও পটিয়ার কেলিশহর ইউনিয়নের মৌলভী বাজারের পূর্ব পাহাড়ে অন্তত ২০ শ্রমিককে আটকে মুক্তিপণ আদায় করেছেন সন্ত্রাসীরা। একাধিক বাগান মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বাগান মালিক ও কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, বাগান থেকে গাছ কেটে আনার সময় দুই গাড়ি চালককে আটকে রাখেন সন্ত্রাসীরা। এক লাখ টাকার চাঁদা দাবি করেন তারা। তাদের সঙ্গে রফাদফা করে এক চালককে দিয়ে ৭০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। পরে মুক্তি পায় দুই চালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাগান মালিক আরও বলেন, সন্ত্রাসীরা রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা এলাকা। কামাল ও তোফায়েল বাহিনী বলে জানা গেছে। একেকজনের ১০-১৫টি মামলা রয়েছে বলেও ফোনে জানিয়েছেন সন্ত্রাসীরা। এখন পাহাড়ে আস্তানা গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন তারা।
স্থানীয় ও অপহৃত একাধিক ব্যক্তিরা বলেন, কড়লডেঙ্গার শতাধিক লোক বিভিন্ন পাহাড়ে কাজ করতে যান। সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ কিলোমিটার গহিনে ওঁৎ পেতে থাকেন সন্ত্রাসীরা। পাহাড়ি ঢাল ও ছড়া ধরে গহিন পাহাড়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মারধর ও গাছে বেঁধে ফেলা হয়। একে একে ৭০-৮০ জন শ্রমিককে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে স্থানীয় ৮-১০ জনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়েছে। অন্যদের কাছে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়। এর আগেও কড়লডেঙ্গা ও কেলিশহরের পাহাড়ি এলাকায় অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন ৩২ বাগান মালিক ও শ্রমিক। অস্ত্রধারী ১০-১৫ জন সন্ত্রাসী ৫০-৬০ জন শ্রমিককে জিম্মি করেছিল। অনেককে মারধর করে টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যরা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।
গত বছরে ১৫ মে সরফভাটা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বড়খোলাপাড়া এলাকায় ধান কাটার সময় ৩ শ্রমিক অপহৃত হন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ত্রিপুরা সুন্দরী এলাকার গহিন বন থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোবাইলে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। চাঁদা আদায়ের জন্য ৩ শ্রমিককে অপহরণ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে অপহরণের ঘটনা ঘটলেও মুক্তিপণ ছাড়া কেউ ফিরে আসেনি। দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই তিন শ্রমিককে উদ্ধার করেছিল।
২০২০ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি মিনি ট্রাকচালক মোসলেম উদ্দিনকে পটিয়ার পূর্ব হাইদগাঁও আলম মাস্টারের প্রজেক্টের পাশ থেকে ১০-১২ জনের উপজাতি সন্ত্রাসী অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায়। সে চন্দনাইশ উপজেলার পশ্চিম এলাহাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। গত ২ বছরেও পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর চন্দনাইশের ধোপাছড়ি থেকে এই ঘটনায় জড়িত পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা ও পরিতোষ তঞ্চঙ্গ্যা নামে দুজন পাহাড়ি সন্ত্রসীকে গ্রেপ্তার করেন পিবিআই।
এদিকে প্রতি বছর এ মৌসুমে পাহাড়ের পটিয়া সীমান্তে উপজাতি সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পাহাড়ের শ্রীমাই, বুদবুদি ছড়া, রাঙ্গুনিয়া কমলছড়ি, ক্রুশিয়া, বেনিপাড়া, ছীপছড়িপাড়া, ডলুছড়ি, এলাকায় প্রায় সময় উপজাতি সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন। পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় নিয়ন্ত্রণ রাখতে দীর্ঘদিন ৩ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সক্রিয়। তারা প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বাগান মালিক ও কাজে যাওয়া শ্রমিকদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি চাকমা গ্রম্নপ ও একটি বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাসী গ্রম্নপ। তারা জলপাই কালারের পোশাক ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে থাকে।
পটিয়া থানার ওসি জসীম উদ্দীন বলেন, আমি পটিয়া থানায় নতুন এসেছি। তবে পাহাড়ে অপহরণের ব্যাপারটি শুনেছি, এখনো পর্যন্ত কেউ কোনোভাবেই আমাদের জানায়নি। বিষয়টি নিয়ে কিভাবে কাজ করা যায় আমরা ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করছি।