পঞ্চম দিন নতুন বই এসেছে ৭০টি
ছিমছাম মেলায় বাড়ছে ভিড়
প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
এবারের অমর একুশে বইমেলা ছিমছাম। পরিসরও বেড়েছে। এ বছর উদ্বোধনের পর দুই দিন সরকারি ছুটি থাকায় পাঠক-লেখক-দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর ছিল অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ। তবে গত কয়েক দিন মেলা প্রাঙ্গণের অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা শুনতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সোমবার মেলা প্রাঙ্গণ অনেকটাই গোছানো মনে হয়েছে। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মেলার মাঠও দেখা গেছে অনেকটা পরিষ্কার। কিন্তু এখনো বিন লাগানো হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সার্বক্ষণিক মেলার মাঠ পরিচ্ছন্ন রাখতে তৎপর। সোমবার কর্মব্যস্ত দিন হওয়ায় মেলার শুরুতে হালকা মেজাজ দেখা গেছে। এদিন মেলার শুরুতে যারা এসেছেন তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে-ফিরে বই কিনেছেন। সময় নিয়ে বই নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছেন আগতরা। তবে সন্ধ্যার আগে সব বয়সি পাঠক-দর্শনার্থীর উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এদিন নবীন-প্রবীণ অনেক লেখক এসেছিলেন মেলায়। তরুণ লেখকদের সমাগম ছিল বেশি। এদিকে প্রতিদিনই মেলা ঘিরে প্রকাশিত হচ্ছে নতুন বই। মেলার মূলমঞ্চে থাকছে নানা অনুষ্ঠান।
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পঞ্চম দিনে কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি মিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ৭০টি বই।
বইমেলায় আসা তন্ময় দাশ বলেন, 'আজই প্রথম এলাম। বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখছি। কিন্তু অধিকাংশ প্রিয় লেখকের বই এখনো আসেনি। তাই ভাবছি আবারও আসব মেলায়। মেলার পরিবেশটা ভালো লাগছে। নতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।'
অনুভব প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী তুষার প্রসূন বলেন, 'এবার মেলায় আমার প্রকাশনী থেকে ৩০টি নতুন বই আসবে। বরাবরই মেলার প্রথম সপ্তাহে বিক্রি একটু কম হয়। প্রথমদিকে ঘুরতে আসেন মানুষ। আশা করছি, আগামী সপ্তাহে জমে উঠবে মেলা। আর ২১ ফেব্রম্নয়ারির পর বিক্রি বাড়বে। আমরা সেই আশায় আছি।'
বইমেলায় প্রযুক্তি, অডিওবুক
গত কয়েক বছর ধরেই প্রকাশকরা ডিজিটাল ভার্সনের বই প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভিন্নধারার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'কাহিনীক লিমিটেড' সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চত্বরের ৩৯৭ নম্বর স্টলে আসা সাহিত্যপ্রেমীদের 'কাহিনীক' অ্যাপের মাধ্যমে সাহিত্যরস আস্বাদনের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ধ্রম্নপদ ও সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার হিসেবে শতাধিক অডিওবুক নিয়ে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে কাহিনীক। দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভালোমানের বই নিয়ে তারা অডিওভার্সন করেছে। শুধু কাহিনীক নয়, কাব্যিক ও শুনবই নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানও পাওয়া গেল বাংলা একাডেমি চত্বরে।
শুনবই-এর স্টলের দায়িত্বে থাকা সিমু আক্তার বলেন, 'আমাদের এই উদ্যোগটি মূলত সব শ্রেণির মানুষের জন্য। মানুষ এখন অনেক বেশি ডিজিটাল মাধ্যমে সময় কাটায়। অনেকে মোবাইলে পড়তে চান না। তাদের জন্য আমাদের অডিওবুকের ব্যবস্থা। শিশুরা যেমন অডিওবুক শুনতে পারে, তেমনি অনেক বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, যারা পড়তে পারেন না, তাদের জন্যই আমাদের এই আয়োজন। দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।'
এ বিষয়ে অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মিলন নাথ বলেন, 'পাঠক, বই ও সাহিত্যপ্রেমীদের তরুণ অংশ এখন ডিজিটাল ডিভাইস-নির্ভর। সেই প্রবণতা বিবেচনায় রেখেই অডিও ভার্সনে পাঠক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অবিরাম চেষ্টা চলছে। আশা করছি, এ ক্ষেত্রে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে যাবে আমাদের বইয়ের প্রকাশ ও প্রচারণা। প্রযুক্তি হচ্ছে এই সরকারের ভিশন। এই ভিশনের সঙ্গে আমরাও আছি।'
বাংলা একাডেমি চত্বরে থাকা সবচেয়ে বেশি বই রয়েছে রকমারি ই-বুকে। স্টলে থাকা শিমুল মোলস্না বলেন, 'আমাদের ই-বুকে সাত হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। কিছু বই ফ্রি পড়া যায়। আর কিছু বই টাকা দিয়ে পড়তে হয়। সব ধরনের লেখকের বই আছে আমাদের অনলাইনে। গত এক বছরে আমরা চার হাজারেরও বেশি বই অনলাইনে যুক্ত করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে।'
অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক বলেন, 'বইমেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ডিজিটাল প্রকাশক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল প্রকাশনার এই ভাবনায় উদ্বুব্ধ হয়েছেন অনেক প্রকাশক। ইতোমধ্যে অনেকে বইয়ের অডিও, ভিডিও ফরম্যাট করার চেষ্টা করছেন। ফলে আমরাও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাব।'
ফুল বিক্রি করে উচ্ছ্বসিত শিশুরা
বইমেলায় পাঠকদের বড় অংশই নারী। মেলায় ঢুকে চোখের সামনে পড়তেই ফুলের টায়রা কিনতে দেখা গেছে তাদের। কেউ নিজের জন্য কিনছেন। আবার পুরুষ সঙ্গীও কিনে দিচ্ছেন সঙ্গে থাকা নারীকে। ফুলের টায়রা মাথায় দিয়ে দলবেঁধে ঘোরাঘুরি এবং সেলফি তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কিশোরী-তরুণীরা। অন্যদিকে ক্রেতাদের কাছে ফুল বিক্রি করতে পেরেও পথশিশুরা উচ্ছ্বসিত।
ফুল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুল বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় করছে তারা। শুধু ফুল নয়, কেউ কেউ রঙিন বেলুনও বিক্রি করছে। তাদেরও বেশ আয় হচ্ছে।
ফুল বিক্রেতা মনিকা জানান, একটি টায়রা ৫০-৮০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে বেশ ভালোই লাভ হচ্ছে। সকালে শাহবাগ থেকে ফুল সংগ্রহ করে তার বাবা এবং মা মেলার বাইরে টায়রা তৈরি করে আর সে মেলায় নিয়ে বিক্রি করে।
মেলায় ঘুরে ঘুরে পছন্দের বই দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠা পাঠক জলাধারের কিনারে কিংবা মেলার বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নেন। এ সময় তারা কফি পান করেন। বইমেলায় দিনে দেড় থেকে দুই হাজার কাপ কফি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বিক্রেতা মিলন জানান, বইমেলার প্রথম সপ্তাহ হওয়ায় বেচাবিক্রি কম। তবে মেলা জমলে বিক্রিও বাড়বে।
মূল মঞ্চে অনুষ্ঠান
এদিকে সোমবার বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সার্ধশত জন্মবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদ রহমান। আলোচনায় অংশ নেন ইসরাইল খান এবং তপন বাগচী। সভাপতিত্ব করেন সাইফুল আলম।
প্রাবন্ধিক বলেন, 'মানোত্তীর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির সমূহ প্রতিভা ছিল মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরীর। মাত্র ষাট বছরের জীবনে তার যে সাধনা ও কীর্তি, তা তাকে বাঙালির নবজাগরণের ইতিহাসে স্মরণীয়জনের আসন দিয়েছে। একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক-সম্পাদক, সংগঠক ও রাজনীতিক হিসেবে তিনি বরেণ্য।'
আলোচকরা বলেন, 'মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরীর বড় পরিচয় হলো সাময়িকপত্র সম্পাদনা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী। তৎকালীন সময় শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন রওশন আলী চৌধুরী সাহিত্যচর্চায় মানুষকে উৎসাহী করে তোলার জন্য আজীবন পরিশ্রম করেছেন।'
সভাপতির বক্তব্যে সাইফুল আলম বলেন, 'মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী নিজে যেমন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, তেমনি লেখক-সাহিত্যিকদের একত্রিত করেছেন, সংঘবদ্ধ করেছেন। তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অবগত করার দায়িত্ব আমাদের যথাযথভাবে পালন করতে হবে।'
'লেখক বলছি' মঞ্চে নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি নাসির আহমেদ, কবি ইসলাম রফিক, শিশুসাহিত্যিক চন্দনকৃষ্ণ পাল এবং লোকসাহিত্য গবেষক সৈয়দা আঁখি হক।
অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন- কবি রবীন্দ্র গোপ, সরকার মাসুদ এবং মাসুদ পথিক।
আজকের অনুষ্ঠান
বিকাল ৪টায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন' শীর্ষক স্মরণ অনুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জফির সেতু। আলোচনায় অংশ নেবেন শাহিদা খাতুন এবং সৌমিত্র শেখর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন আবদুল খালেক।