রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিল্প খাতে নীরবে বেকারত্ব বাড়ছে

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা -ফাইল ছবি

গ্যাস-বিদু্যৎ সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে কার্যাদেশ কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আকারের পোশাক কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সংকট এবং অস্থিতিশীল আর্থিক পরিস্থিতি। নানামুখী চাপ সামলাতে না পেরে মালিকরা বেশকিছু গার্মেন্টস গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ গোপনে ধাপে ধাপে শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখার চেষ্টা করছেন। নিয়মিত বেতন-ভাতা না পেয়ে কোথাও কোথাও শ্রমিকরাই বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়ছেন। এতে শিল্প খাতে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

এর ওপর তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের ওপর সরকারি নগদ প্রণোদনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাবও শ্রমিকদের ওপর পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বাজার। রাজনৈতিক কারণে ওই সব বাজার ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যেই গ্যাস-বিদু্যতের ঘাটতি গোটা শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় অঞ্চল চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকার শিল্প কারখানার চালচ্চিত্রে যা এখনই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

গার্মেন্টস শিল্পমালিকরা জানান, বৈশ্বিক মন্দায় ইউরোপ আমেরিকায় রপ্তানি কমেছে। দেশে গ্যাস-বিদু্যৎ সঙ্কটের কারণে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। তাতে লোকসানের মুখে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো মতো টিকে আছে আরো কিছু কারখানা। নীরবে শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত আছে। মাসের পর মাস বেতন-ভাতা না পেয়ে অনেক শ্রমিক গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকে পেশা বদল করছেন। কারখানা মালিকের কাছ থেকে পাওনা বুঝে নিয়ে সে টাকায় নিজে নিজে কিছু করার চেষ্টা করছেন অনেক শ্রমিক। ছাঁটাই কিংবা স্বেচ্ছায় শ্রমিকরা চলে যাওয়ার পর শূন্য পদ পূরণ করা হচ্ছে না। সিংহভাগ পোশাক কারখানায় নতুন নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। নতুন কারখানা চালু করা দূরে থাক বিদ্যমান কারখানাও পুরো দমে চালু রাখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বেশকিছু কারখানা গুটি কয়েক ইউনিট চালু রেখে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

চট্টগ্রাম গার্মেন্টস মালিকদের একাধিক সূত্র জানায়, ১৯৭৮ সালে সেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানির গোড়াপত্তন হয়েছিল। এক সময় ছোট-বড় মিলিয়ে আট শতাধিক কারখানা ছিল। '৯০-এর দশকেও দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশের বেশি হিস্যা ছিল চট্টগ্রামের। সেটি ধীরে ধীরে কমছে। বিজিএমইএর হিসাবে এখন চালু কারখানার সংখ্যা ৪০০। এর মধ্যে সরাসরি পণ্য রপ্তানি করে ২৯০টির মতো কারখানা। বাকিগুলো অন্যের হয়ে সাবকন্ট্রাক্টে পোশাক উৎপাদনের কাজ করে।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক মাসে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। অনেক কারখানা মালিক নীরবে শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। কোনো কোনো কারখানায় মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে পেশা ছেড়ে গেছেন। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে মিছিল-সমাবেশ হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকরা নীরবেই কারখানা ছেড়ে গেছেন। কোথাও কোথাও গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের মোট পাওনার সামান্য অংশ ধরিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের বিদায় করে দিচ্ছেন। কাজ নেই, বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ার অবস্থাও নেই। এ অবস্থায় নিজ থেকে চলে গেছেন অনেক শ্রমিক।

বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় পোশাক রপ্তানি কেবলিই কমছে। এতে চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে উৎপাদন ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। অনেক কারখানার একাধিক ইউনিট বন্ধ রয়েছে। কাজ না থাকায় অনেক শ্রমিক পেশা বদল করে চলে গেছে। অনেকে শহরের জীবন ছেড়ে গ্রামে চাষাবাদ করছে। নতুন করে শ্রমিক নিয়োগও প্রায় বন্ধ। দেশে গ্যাস-বিদু্যতের সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে কারখানা মালিকরা লোকশানের মুখে পড়েছেন। দফায় দফায় গ্যাস, বিদু্যৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করেও গ্যাস, বিদু্যৎ পাওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিনে গ্যাস সংকট আরো প্রকট হয়েছে। গ্যাস, বিদু্যৎ আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহণসহ সব খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পোশাক খাতে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে অনেকে উৎপাদন কমিয়ে পোশাকে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছেন। বিদেশে বাজার ধরে রাখার এই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও

দেখা যাচ্ছে না।

গাজীপুরের গার্মেন্টস মালিকরা জানান, এলাকার টঙ্গী, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুরের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে লাখ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে গার্মেন্টস মালিকরা সময়মতো বেতন পরিশোধ করতে না পারায় বেশকিছুদিন ধরে সেখানে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, সময় মতো কাঁচামাল সরবরাহ না হওয়া, গ্যাস সংকট, বিদেশি বায়ার কমে যাওয়ায় তারা অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। যে কারণে সময় মতো শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে এরই মধ্যে গাজীপুরের একাধিক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে বেতন না দিয়ে এসব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বকেয়া বেতন আদায়ে মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

বিকেএমইএ সভাপতি মো. হাতেম বলেন, পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিকভাবে মন্দা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ঢামাডোলের কারণে আন্তর্জাতিকভাবেই সেল ও অর্ডার কমের জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর ওপর দেশের ব্যাংকগুলো নানামুখী সংকটে পড়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাবে শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেকারত্ব বাড়ছে।

টেক্সটাইল মিল মালিকরা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দাম বাড়ানোর সময় সরকারের তরফে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন হয়নি। ট্যারিফ বৃদ্ধির আগে এবং পরে গ্যাস সরবরাহের অবস্থা শোচনীয়ই রয়ে গেছে। বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্পমালিকরা। কারখানা বন্ধ হওয়ায় শুধু রপ্তানিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দিন দিন বাড়ছে বেকারত্ব। অনেক টেক্সটাইল মিলের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এরই মধ্যে বেকার হয়েছে। এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি)-এর তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় তৈরি পোশাক রপ্তানি ১ দশমিক ২৪ শতাংশ কমে ১ হাজার ১৩৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইইউর সবচেয়ে বড় বাজার জার্মানিতে পোশাক রপ্তানি ১৭ শতাংশ কমে ২৮৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ইতালিতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি গত বছরের প্রথম ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭৯ কোটি ডলারে। ২০২২ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯০৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কানাডায় তৈরি পোশাক রপ্তানি ৪ শতাংশ বেড়ে ৭৪ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের ওপর সরকারি নগদ প্রণোদনা কমিয়ে আনার নতুন সিদ্ধান্তে গার্মেন্টস বন্ধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এ খাতের শ্রমিকদের বেকারত্ব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এমনটা আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তরা অনেকেই।

এ প্রসঙ্গে গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমই এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বেশি টানাপোড়েন চলছে। রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও মুনাফা সেই হিসেবে বাড়ছে না।

তিনি বলেন, মন্দার কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব কিছুর উৎপাদন মূল্য বেড়ে গেছে। সেই হিসেবে রপ্তানির মূল্য বেড়ে গেছে। কিন্তু এক্সপোর্টের ভ্যালু (মূল্য) বেড়ে যাওয়া মানেই মালিকরা সেই টাকা পাচ্ছে- তা নয়। মালিকরা সিএম বা চুক্তি অনুযায়ী দাম পাচ্ছে।

মহিউদ্দিন রুবেলের দাবি, এসব বিভিন্ন কারণে আয় এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, সেই সঙ্গে বাজারে এখন পর্যাপ্ত অর্ডার নেই। এছাড়া গত কয়েক বছরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক গুণ করে বেড়েছে। এমন অবস্থায় প্রণোদনা কমানো হলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। যার পরোক্ষ প্রভাবে শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এ খাতে কর্মসংস্থান কমবে।

এদিকে শ্রমিক নেতারা অনেকে মনে করেন, পোশাকশিল্পে নানা সংকটের কারণে শ্রমিক উৎপাদন কমে যাওয়ায় কোথাও কোথাও শ্রমিক ছাঁটাই করা হলেও এর নেপথ্যে ভিন্ন কারণও রয়েছে। তাদের ভাষ্য, নতুন মজুরি বাস্তবায়ন না করার কৌশল হিসেবেই শ্রমিক ছাঁটাই করছেন অনেকেই।

শ্রমিক সংগঠন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড কেন্দ্রের (জিটিইউসি) সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামিমের দাবি, শুধু তাদের সংগঠনের ২২ হাজারের বেশি শ্রমিককে আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে গত দুই-আড়াই মাসে ছাঁটাই করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে