শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

শিশুদের পদচারণায় মুখর মেলা

মেলার দ্বিতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ৩১টি ছুটির দিনে দুপুরেই লোকারণ্য মেলা প্রাঙ্গণ
যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় দিন শুক্রবার শিশুদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে 'শিশুপ্রহর'। এদিন সিসিমপুর মঞ্চ উদ্বোধন শেষে হালুম, ইকরি ও টুকটুকিদের নাচ দেখে উচ্ছ্বসিত সোনামণিরা -ফোকাস বাংলা

একদিন আগেই পর্দা উঠেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলার। আর দ্বিতীয় দিন ছুটির দিন হওয়ায় শিশুদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে 'শিশুপ্রহর'। এদিন বেলা ১১টায় দর্শনার্থী-ক্রেতার জন্য খুলে দেওয়া হয় বইমেলার দুয়ার। সোয়া এগারটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরে উদ্বোধন করা হয় শিশু প্রহরের।

ছোটদের মূল আকর্ষণ শিশুপ্রহরে সিসিমপুর মঞ্চ উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সিসেমি ওয়ার্কশপের বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম, বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মোজাহিদুল ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

কবি নূরুল হুদা বলেন, "এবার আমরা বইমেলার স্স্নোগান রেখেছি- 'পড় বই গড়ো দেশ/বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'। এই বাক্যটির সঙ্গে আরেকটি বাক্য বলব- সেটি হলো 'বিশ্বজোড়া বিশ্বদেশ'। আমরা বই পড়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ গড়তে চাই। সেই সঙ্গে বিশ্বের সুনাগরিক হতে চাই। বাংলাদেশ এবং সৃজনশীলতা চিরজীবী হোক।"

শিশুচত্বর ঘুরে দেখা গেছে, বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরা এসেছে মেলায়। সিসিমপুর স্টেজে হৈ-হুলেস্নাড়ে মেতে উঠেছে তারা। পাশাপাশি বাবা-মায়েরাও স্টেজের বাইরে থেকে শিশুদের সাড়া দিচ্ছেন। শিশু প্রহর উদ্বোধনের পর থেকেই শুরু হয় সিসিমপুরের জনপ্রিয় চরিত্র হালুম, ইকরি ও টুকটুকিদের নাচ। সিসিমপুরের সরাসরি এই চরিত্র দেখে উচ্ছ্বসিত শিশুরা।

অভিভাবকরা বাচ্চাদের নিয়ে বইয়ের স্টলে স্টলে ঘুরছেন। বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বইয়ের সঙ্গে। বই খুলে বাচ্চারাও বিভিন্ন বর্ণমালা ও ছড়া পড়ছে। মেলায় শিশু চত্বরে রয়েছে তাকডুম, ঘাসফড়িং, ফুলঝুরি, সিসিমপুরসহ অনেক স্টল। স্টলগুলোতে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, ইংরেজি বর্ণমালা, গল্প, ড্রইং, ফিকশন, রঙবেরঙের ছবিসহ

অসংখ্য বই। শিশুদের সঙ্গে মুখরিত বিক্রয়কর্মীরাও।

বইমেলায় সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে এসেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা দিপালি রানী দাস। তিনি বলেন, 'দুই বাচ্চাসহ অনেক দূর থেকে এসেছি বৃহস্পতিবার। বাচ্চাদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতেই বইমেলায় আসা। মেলা থেকে বাচ্চাদের পছন্দমতো বই কিনেছি ৫টি। তাদেরকে ঘুরে ঘুরে মেলা দেখাচ্ছি।'

ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিম বলেন, 'আম্মুর সঙ্গে মেলায় এসেছি। গত বছর আসতে পারিনি। কমপক্ষে ১০টি বই কেনার ইচ্ছা। সিসিমপুর অনেক বেশি আনন্দ দিচ্ছে। আগে টিভিতে দেখতাম, আজ সরাসরি হালুমকে দেখেছি।'

রাজধানীর আব্দুলস্নাহ মেমোরিয়াল স্কুল থেকে এসেছেন নাফিয়া অথৈ ও সাদিয়া। তারা বলেন, 'শিক্ষকরা আমাদের নিয়ে এসেছেন। দুপুরের মধ্যে আবার স্কুলে চলে যাব। গত বছর বাবা মায়ের সঙ্গে এসেছিলাম। এ বছর স্কুল থেকে বন্ধুরা মিলে এসেছি খুব ভালো লাগছে।'

মেলার মাঠে বসেই 'আবিষ্কারের মজার গল্প' নামে একটি বই পড়ছিল ফারিস্তা। সে জানায়, মেলা থেকেই বইটি কিনেছে।

ফারিস্তার বাবা খোকন আহমেদ বলেন, 'আমার মেয়ে বই পড়তে পছন্দ করে। আমিও প্রতি মাসে বই কিনে দিই। আজকে মেলায় এসে বই কিনে এখানেই পড়া শুরু করে দিয়েছে।'

শিশুচত্বরে অধিকাংশ স্টল গোছানো থাকলেও সামনের মাঠ অনেকটাই উঁচুনিচু। কোথাও কোথাও রয়েছে ছোট ছোট গর্ত। অভিভাবকদের কেউ কেউ বললেন, মাঠ সমান করে দিলে সবার হাঁটা নিরাপদ হতো।'

তাকধুম স্টলের বিক্রয়কর্মী ওভি বলেন, 'সকাল থেকে শিশুরা ছিল সিসিমপুরে। আজ ভালো বেচাকেনা হয়েছে।'

বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা বিষয়গুলো দেখছি। পাশাপাশি প্রকাশকদের অনুরোধ করব, তারা যদি স্টলের সামনের জায়গাটা একটু পরিষ্কার রাখেন, তাহলে সুন্দর হয়। অনেকে স্টলের কাজ করে সামনে পড়ে থাকা কাঠের টুকরোগুলোও পরিষ্কার করেননি। অন্তত স্টলের হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম

সামনের জায়গাটি পরিষ্কার রাখলে তাদের স্টলটিই সুন্দর দেখাবে।'

বিকালে দর্শনার্থী ঢল

প্রথম ছুটির দিন দুপুরের পর থেকেই বইমেলায় ঢল নামে দর্শনার্থীর। সরেজমিন দেখা যায়, এ বছরের বইমেলায় বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং পস্ন্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন অংশের মোট ৮টি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ দিয়ে পাঠক-দর্শনার্থীরা আসা-যাওয়া করতে পারছেন।

তবে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে একটি বের হওয়ার পথে। বাংলা একাডেমির দিকে বের হওয়ার পথটিকে এবার একটু সরিয়ে রমনা মন্দির গেটের কাছাকাছি নেওয়া হয়েছে। ছুটির দিন হওয়াতে সকাল এগারোটা নাগাদ শুরু হয়েছে বইমেলা। তবে ভিড় বেড়েছে দুপুরের পর থেকে।

সরেজমিন দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলায় টিএসসি সংলগ্ন গেট দিয়েই প্রবেশ করছেন অধিকাংশ মানুষ। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ আলাদাভাবে ভেতরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। তবে শুরুতেই পড়তে হচ্ছে পুলিশের নিরাপত্তা তলস্নাশিতে। মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বরাবরের মতোই মূল ফটকের সামনে অনুসন্ধান- ঘোষণা বুথ এবং মেলার ম্যাপ রাখা হয়েছে। এরপর ভেতরের দিকে বিস্তৃত হয়েছে প্যাভিলিয়ন, স্টল এবং লিটলম্যাগ।

মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা বলছেন, মানুষের সুবিধার্থে বইমেলা চলাকালীন সময়ে অন্তত শুক্রবার দিন মেট্রোরেল দুপুরের পর থেকে রাত পর্যন্ত চালু রাখা হোক। এতে করে যাতায়াতে সুবিধা পাবেন সবাই। দূর-দূরান্ত থেকে আসতে যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে মেট্রোরেল চালু রাখলে সহজেই বইমেলায় আসা যাবে।

সোহানুর রহমান নামের এক দর্শনার্থী বলেন, 'অমর একুশে বইমেলা আমার কাছে বড় উৎসবের মতো মনে হয়। এখানে না আসলে অনেকটা অপূর্ণতা থেকে যায়। তাই শুরুর দিকেই ঘুরতে এসেছি। এখনো কোনো বই কেনাকাটা করিনি। তবে ভালো লাগলে কিনে নেব। চারপাশের পরিবেশ এবং অনেক বই দেখে খুবই ভালো লাগছে।'

সামিরা ইয়াসমিন তিন্নি নামের আরেক ক্রেতা বলেন, 'অন্য বছরের তুলনায় এবার পরিসর বেশ বড় মনে হচ্ছে। আর বেশ গোছানো। শুরুর দিকেই মেলার আয়োজনও বেশ সমৃদ্ধ।'

অন্যদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে দেখা গেছে পুলিশ, ডিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে জানানো হয়, মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র?্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলায় তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রতিদিন ছুটির দিন ব্যতীত বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে রাত ৮টা ৩০ এর পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। আর ছুটির দিন বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ২১শে ফেব্রম্নয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন মেলা চলবে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

দ্বিতীয় দিনে ৩১টি বই প্রকাশিত

এদিকে বাংলা একাডেমি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বইমেলার দ্বিতীয় দিন মেলায় নতুন বই এসেছে ৩১টি। এদিন বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ : মহাকবি আলাওল শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইমন জাকারিয়া। আলোচনায় অংশ নেন মিল্টন বিশ্বাস এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মো. আবুল কাসেম।

প্রাবন্ধিক বলেন, 'বাঙালি ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের অবাঙালি গবেষকদের বিচারে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকের কবি আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আখ্যান কবি হিসেবে স্বীকৃত। আলাওল রচিত পদ্মাবতী, সিকান্দরনামা, তোহ্‌ফা, রাগতালনামা ও পদাবলী এবং কাজী দৌলতের সতী-ময়না লোর-চন্দ্রাণী'র শেষাংশ হস্তলিখিত পান্ডুলিপির সাহায্যে সম্পাদিত গ্রন্থাকারে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন নতুন তথ্যের আলোকে মহাকবি আলাওলকে যে তত্ত্বীয় পরিসরে গবেষকগণ উপস্থাপন করছেন তাতে তার সাহিত্যের গভীরতা, দূরদৃষ্টি-সম্পন্নতা এবং মহাকাল স্পর্শের ক্ষমতা স্পষ্ট হয়।'

আলোচকরা বলেন, "মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম 'ছয়ফুলমুলক-বদিয়ঃজ্জামান'। এই কাব্যের পরিচয় কেবল আখ্যানকাব্য বা প্রণয়োপাখ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই কাহিনি কিচ্ছা আকারে যাত্রাপালায়ও পরিবেশিত হয়েছে। কাজেই এই পুথির আবেদন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত।"

সভাপতির বক্তব্যে মো. আবুল কাসেম বলেন, 'মধ্যযুগে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে বাংলা ভাষা মুসলমানের ভাষা নয়, হিন্দুর ভাষা। তথাপি মধ্যযুগের মুসলমান কবিগণ বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিতকর্ম রচনা করেছেন। মহাকবি আলাওলও এর ব্যতিক্রম নন। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের একাধিক পাঠ থেকে লেখকের অভিপ্রেত পাঠটি পুনরদ্ধার করাই পান্ডুলিপি বা পুথি সম্পাদনার মূল উদ্দেশ্য। এই কষ্ঠসাধ্য কাজে তরুণ গবেষকদের উৎসাহিত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পুথি এবং পান্ডুলিপি সহজলভ্য করতে হবে।'

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রুবী রহমান, আসাদ মান্নান এবং মাহবুব সাদিক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ, মুস্তাফা ওয়ালিদ এবং মজুমদার বিপস্নব। এছাড়া ছিল ড. আবুল কালাম আজাদের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদ' এবং ড. মো. শাহাদাৎ হোসেনের পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন 'বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদ'-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী তিমির নন্দী, মহিউজ্জামান চৌধুরী, প্রিয়াংকা গোপ, জুলি শারমিলি এবং মানিক রহমান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন গৌতম মজুমদার (তবলা), এ কে আজাদ মিন্টু (কী-বোর্ড), মো. ফারুক (অক্টোপ্যাড) এবং রিচার্ড কিশোর (গিটার)।

আজকের অনুষ্ঠান

আজ বইমেলার ৩য় দিন মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিশতজন্মবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : মাইকেল মধুসূদন দত্ত শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রফিকউলস্নাহ খান। আলোচনায় অংশ নেবেন খসরু পারভেজ এবং হোসনে আরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে