শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

'বিষটোপে' অতিথি পাখি নিধন

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শীত এলেই দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা মেলে দূরদূরান্ত থেকে আসা পরিযায়ী পাখির। পানিতে অবগাহনের দৃশ্য মন কাড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের। ছবিটি বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের নাজিরপুর লেক থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

শীতকালে উষ্ণতার খোঁজে শীতপ্রধান নানা দেশ থেকে বাংলাদেশের জলাধারগুলোকে আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় পরিযায়ী পাখি। টাঙ্গাইলের চারান, চাপড়া, মলাদহ, ঝাইতলা, বরকম, পুঁইটা, নেধার বিলসহ বিভিন্ন জলাধারেও এখন অতিথি পাখির কিচিরমিচির। পাখি দেখতে অনেকেই ঘুরতে আসছেন এসব বিলে। পাখিদের ঝাঁক বেঁধে একসঙ্গে ওড়ার দৃশ্য দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। তবে বিষটোপসহ শিকারিদের নানা ফাঁদে আটকা পড়ছে এসব পাখি। এতে দিন দিনই কমছে অতিথি পাখির বিচরণ।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১০৪৩ দশমিক ৫০ হেক্টর আয়তনজুড়ে ১২৮টি খাল, ৬৮০৮ দশমিক ৩৪ হেক্টর আয়তনজুড়ে ২৭৭টি বিল ও ১০১৫ দশমিক ৭৪০ হেক্টর আয়তনের ৮২টি জলাশয় রয়েছে। এ ছাড়া ৪৮ দশমিক ৩৩ হেক্টর আয়তনের ১৭২টি পস্নাবন ভূমি রয়েছে এ জেলায়।

জেলার ১২টি উপজেলার চর নিকলা বিল, কয়েড়া ধোপাচড়া বিল, আমুলা বিল, বর্ণিবিল, বার্থাবিল, বালিয়া বিল, নিরাইল বিল, চারান বিল, দোগাঙ্গীবিল, মলাদহবিল, ঝাইতলাবিল, বরকমবিল, পুঁইটাবিল, ধোপারকমবিল, খৈইলাকুড়িবিল, আদমবুইড়াবিল বিভিন্ন খাল-বিল-জলাশয় ও পস্নাবন ভূমিতে শীত মৌসুমে দেশি পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখি এসে যোগ দেয়। স্থানীয় বোরো ধানের খোলা মাঠে বা জলাধারের কিনারে অল্প পানিতে মাছ শিকারের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে কানিবক, গো-বক, ছোট সাদা বক, বেগুনি বক, বড় বক, নিশি বক, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককনা, গাঙ কবুতর, মানিকজোড়সহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি পাখি শীত মৌসুমে খেলা করে। পাখিরা রাতে সাধারণত আশপাশের গাছগাছালিতে আশ্রয় নেয়।

দিনভর পাখিগুলো ছোট ছোট মাছ ও জলজপ্রাণি নানা ভঙিমায় শিকার করে খায়, কিচিরমিচির কলকাকলীতে মেতে ওঠে এবং মাঝেমধ্যেই ঝাঁক বেঁধে জলাশয়ের পাশে উড়ে বেড়ায়। এ দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরাও ভোর থেকে বিকাল পর্র্যন্ত জলাধারে বেড়াতে আসে।

তবে এক শ্রেণির শিকারি অভিনব কায়দার 'বিষটোপ'সহ নানা ফাঁদে ফেলে পাখি নিধনে মত্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ এসব পাখি শিকার করে স্থানীয় মাংশাসিদের কাছে চড়াদামে বিক্রি করছে। ফলে জেলার খাল-বিল-জলাশয় ও পস্নাবন ভূমিগুলোতে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখির বিচরণ কমছে।

জানা যায়, মাছের পেটে বাসুডিন, ফুরাডান ও কার্বোটাফ নামে এক ধরনের বিষ ঢুকিয়ে খাল-বিলে বা খোলা মাঠে ছিটিয়ে রাখা হয়। এসব মাছ খেয়ে পাখি অচেতন হয়ে পড়ে। সেগুলো ধরে নিয়ে বিক্রি করা হয় হাটবাজারে। তবে এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পাখির বিচরণ কমে যাবে, যা পরিবেশের ভারাসাম্য নষ্ট করবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাখি শিকার ও বিক্রয় দন্ডনীয় অপরাধ। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল বা এক লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার কথা বলা হয়েছে। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিকারি জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে শখের বসে খাল-বিল-জলাশয় ও পস্নাবন ভূমি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককণা শিকার করে থাকেন। এগুলো তারা বিষ জাতীয় দ্রব্য বা বাটালের মাধ্যমে শিকার করেন। তবে বিষ খেয়ে অসুস্থ ও বাটালের মাধ্যমে ছোঁড়া মারবেলের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে অচেতন হয়ে পড়লে তারা ধরে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করেন। শিকার করা বক পাখির আকার ভেদে প্রতিটি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।

কলেজ পডুয়া পাখি প্রেমিক ইসতিয়াক আহমেদ ইমরান জানান, সঠিক নজরদারি ও জনসচেতনার অভাবে পাখি নিধন বেড়েছে। এটা দন্ডণীয় অপরাধ জেনেও শিকারিরা বিরত থাকছে না। অতিথি পাখি শিকার রোধে প্রচলিত আইন বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।

বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার জানান, পাখি শিকারের জন্য যে বিষ ব্যবহার বরা হয়, সেটা ওপিসি-জাতীয় বা গণ ফসফরাস কম্পাউন্ড-জাতীয় বিষ। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা মানুষের দেহে সবদিক দিয়েই প্রবেশ করতে পারে। স্কিনের মাধ্যমে খাবার ও শ্বাসনালির মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে। বিষের মাত্রা যদি বেশি থাকে তাহলে মানুষ দ্রম্নত মারা যেতে পারে। আর এটা না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অসুস্থ হতে পারে। যেমন বমি হতে পারে, রক্তচাপ কমে যেতে পারে, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের বিষ দিয়ে শিকার করা পাখি খাওয়া যাবে না। এটি নিরাপদ নয়। এ বিষ আগুনে ফোটালেও নিরাপদ হবে না।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর এএসএম সাইফুলস্নাহ জানান, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধু মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৪০ প্রজাতির পাখির উপস্থিতি রয়েছে। যার অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে রয়েছে বাহারি ধরনের বক পাখি এবং এদের অনেক প্রজাতি টাঙ্গাইল অঞ্চলে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে- কানিবক, গো-বক, ছোট সাদা বক, বেগুনি বক, বড় বক, নিশি বক। টাঙ্গাইল অঞ্চলে কানিবক, ছোট সাদা বকের উপস্থিতি সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এসব বক অধিকাংশই মাংসাশি, মোটকথা এরা ছোট ছোট মাছ খায় এবং এগুলো জলাভূমি, ধান খেত থেকে শিকার খেয়ে থাকে। বক সাধারণত বড় বড় গাছকে আবাস হিসেবে বেছে নেয়। খাবারের স্বল্পতা, খাবারে বিষক্রিয়া, জলাভূমি কমে যাওয়া এবং গাছ ও আবাসস্থল ধ্বংস হলে এদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন এবং এসব ঘটার কারণে বকসহ নানা পাখির বৈচিত্র্য দিন দিন কমে যাচ্ছে।

তিনি মনে করেন এভাবে চলতে থাকলে পাখির অনেক প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বাস্তু সংস্থানের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।

টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, যেসব এলাকায় পাখি শিকার করা হচ্ছে সে অঞ্চলে বনাঞ্চল না থাকায় তাদের তেমন একটা নজরে আসে না। তাছাড়া তাদের জনবল খুব কম থাকায় যথাসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। তবে যারা পাখি শিকার করে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে