কেরানীগঞ্জে এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসাকেন্দ্রই অবৈধ
প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
অনুমোদনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকায় কেরানীগঞ্জ উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসাকেন্দ্রই অবৈধ। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা বাণিজ্য। শুধু অবৈধ তালিকা প্রণয়ন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের চিঠি চালাচালির মধ্যেই যেন সব দায় শেষ। প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া রোগীরা এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অধিকাংশেরই নেই কোনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনপত্র। অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে পরিচালিত অধিকাংশ ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ভুল চিকিৎসায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
অবৈধ ক্লিনিক বন্ধসহ চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় কেরানীগঞ্জ উপজেলা ১০ লাখ মানুষ অনেকটা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এ সুযোগে পাড়া-মহলস্নার আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, সরকারি সনদপ্রাপ্ত দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী, প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতি বেশিরভাগ ক্লিনিকেই মানা হচ্ছে না। এতে ভুল চিকিৎসায় ভোগান্তির পাশাপাশি প্রতারিত হচ্ছেন রোগীরা। শুধু অনুমোদনের জন্য অনলাইনে আবেদন করে, আবার কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু না করেই বহালতবিয়তে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নামে ব্যবসা, প্রতারণা, রোগী ভোগান্তির অভিযোগ উঠছে হরহামেশাই।
কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, আগানগর, শুভাঢ্যা, তেঘরিয়া, বাস্তা, রোহিতপুর, কলাতিয়া, শাক্তা ইউনিয়নসহ ১২টি ইউনিয়নের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে অননুমোদিত কয়েক ডজন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। এসব প্রতিষ্ঠানে টাকার জন্য রোগীকে হয়রানি করা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় ভুল রিপোর্টের কারণে ভুল চিকিৎসা নিয়ে বিপাকে পড়ছেন রোগীরা। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারিকে দুষছেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিন ঘুরে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব কোনো চিকিৎসক, নার্স, প্যাথলজিস্ট বা টেকনিশিয়ান নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতষ্ঠিানগুলো অবাধে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন রোগীরা। সরকারি কোনো তদারকি না থাকায় একশ্রেণির অসাধু ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক চলছে চিকিৎসার নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স থাকলেও সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং তা হালনাগাদ করা হয়নি। অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানায় সরকারের আর্থিক লাভ হলেও জনগণের কোনো উপকারে আসে না। তাই মানহীন এসব ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়ার জোর দাবি সচেতন মহলের। অভিযোগ রয়েছে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কমিশন পাচ্ছে দালাল চক্র। ফলে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা।
লাইসেন্স নেই রিএজেন্ট আসলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. তৌফিক হোসাইন বলেন, 'আমরা মানুষকে সেবা দিচ্ছি। আশপাশের খোঁজ নিয়ে দেখবেন আমরা সেবার মাধ্যমেই এগিয়ে আছি।'
কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজপত্র দিয়ে কীভাবে চলছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'এটি আমার ভুল হয়েছে। শিগগিরই পুনরায় আবেদন করব।'
হেলথ সেন্টার বন্ধের নির্দেশের পর বিডি হেলথ সেন্টার চলমান থাকার বিষয়ে পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা অবৈধ এমন কিছু জানি না, বন্ধের নির্দেশ আমরা পাইনি।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাক্তার বলেন, 'ডাক্তারদেরও অনুমোদনহীন ক্লিনিকে চিকিৎসা দিতে যাওয়া ঠিক নয়। কদমতলী গোলচত্বর এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে একটি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করেন কিন্তু কিছুদিন পরই নতুন নামে আবার পুরোদমে চলছে। অবৈধ কিংবা মানহীন ক্লিনিকগুলোকে শুধুমাত্র জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হলে হবে না, এগুলোকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।'
ঢাকা সিভিল সার্জন অফিস ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ উপজেলায় চিকিৎসার নামে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া বেসরকারি এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিয়ে এতদিন কারোরই কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এখন অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে অভিযানের জন্য। কয়েক দিনের মধ্যেই তালিকা ধরে অভিযানে নামার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কেরানীগঞ্জে রয়েছে অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এর মধ্যে ৭টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে অবৈধ ঘোষণা করে বন্ধের নির্দেশ দেন উপজেলা প্রশাসন। সেগুলো হলো- মালঞ্চ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিডি হেলথ সেন্টার, মেডিমাইন রিসার্চ সেন্টার, ফাইন্ডার হেলথ কেয়ার এন্ড হসপিটাল, মনোয়ারা ডে-কেয়ার সার্জারি ক্লিনিক, টেস্টোলাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিডি ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এখনো চলমান। এদিকে সচেতন মহল বলছে, কেরানীগঞ্জে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নেই। অনলাইনে নিবন্ধনের নামমাত্র আবেদন করেই চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। অধিদপ্তরের সঙ্গে গোপন আঁতাতের অভিযোগও রয়েছে নিবন্ধনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তানভীর আহমেদ জানান, সিভিল সার্জনের সর্বশেষ নির্দেশে উপজেলার উলিস্নখিত সাতটি অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ঢাকা সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মো. সাহাবুদ্দিন খান বলেন, লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যাদের কাগজপত্র ঠিক আছে ও লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন তাদের বিষয়ে হয়তো অধিদপ্তর নির্দেশনা দেবে। অপরদিকে অনিয়মের কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।