রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী আজ

কপোতাক্ষ নদের তীরে জমজমাট মধুমেলা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী আজ বৃহস্পতিবার। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবী। জন্মদিন উপলক্ষে মহাকবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়িতে চলছে ৯ দিনব্যাপী মধুমেলা। এ মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। কপোতাক্ষ নদ পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্তের উপস্থিতিতে এবারও মুখর হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। কবির জন্মভূমির স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ, জমিদার বাড়ির আম্রকানন, বুড়ো কাঠবাদাম গাছতলা, বিদায় ঘাট, মধুপলস্নীসহ এই আনন্দ আয়োজন উপভোগ করতে আসছেন দর্শনার্থীরা।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জমিদার ঘরে জন্মগ্রহণ করেও শুধুমাত্র সাহিত্যকে ভালোবেসে সমাজ সংসার থেকে পেয়েছেন বঞ্চনা আর যন্ত্রণা। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় মারা যান মহাকবি মাইকেল মধুসূদন। এরপর কবির ভাইয়ের মেয়ে কবি মানকুমারি বসু ১৮৯০ সালে কবির প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন সাগরদাঁড়িতে। সেই থেকে শুরু হয় মধু মেলার।

বাংলা সাহিত্যে একাধারে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, প্রথম মহাকাব্য ও সনেটের রচয়িতা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও ৯ দিনব্যাপী 'মধুমেলা' আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। গত ১৯ জানুয়ারি এই মেলার উদ্বোধন হয়। শেষ হবে আগামী ২৭ জানুয়ারি। শতবর্ষী এ মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্তের উপস্থিতিতে এবারও মুখর হয়ে উঠেছে কপোতাক্ষ নদ পাড়। কবির জন্মভূমির স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ, জমিদার বাড়ির আম্রকানন, বুড়ো কাঠবাদাম গাছতলা, বিদায় ঘাট, মধুপলস্নীসহ মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিদিন মধুভক্তদের পদচারণা সরগরম হয়ে উঠেছে। দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য ৯ দিনব্যাপী সাগরদাঁড়ির মধুমঞ্চে কবিকে ঘিরে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্যান্ডেলে সার্কাস, যাদু প্রদর্শনী ও মৃতু্যকূপ রয়েছে।

মেলা উপলক্ষে এলাকার মানুষের ভেতর দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। মেলা প্রাঙ্গণেই শুধু এ মেলার বিস্তার নয়। মেলা উপলক্ষে জামাই আর আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয় গ্রামে। তাই বাড়িতে বাড়িতে খই, মুড়কি, নারকেল আর চালের আটার নাড়ুসহ নানা রকমের পিঠা বানানো হয়েছে। মেলাতে স্বদলবলে এসে মিষ্টি-মিঠাই কিনে বাড়িতে ফেরার রেওয়াজটিও ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী।

গ্রামের প্রবীণ নজরুল শেখ স্মৃতিতে ভেসে বলেন, 'মেলা থেকে আগে লেইস ফিতা, আলতা, সুগন্ধি তেল, পাটের তৈরি শিকি (শিকে)

কিনতাম। সময় বদলেছে, তারপরও মেলায় আসি।'

মধুসূদন একাডেমির পরিচালক কবি ও মধুসূদন গবেষক খসরু পারভেজ বলেন, 'আশির দশক থেকে মধুমেলা শুরু হয়েছে। প্রথমদিকে মেলায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা ও কুটির শিল্পের পসরা বসত। মেলার ব্যাপ্তি বাড়ায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি বর্তমানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দোকানপাটের পসরা বসে।'

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা কাজি রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এখন তো জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসন মেলার আয়োজন করে। আগে কবির জমিদার বাড়ির মধ্যে মেলা বসত। মেলার পরিধি ও লোকসমাগম বেশি হওয়াতে মেলাটি পাশেই একটি স্কুল মাঠে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মধুমেলাকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে আত্মীয়-স্বজন আসতে শুরু করেছে। অনেকেই মেয়ে-জামাই, বন্ধু-বান্ধবসহ অতিথিদের দাওয়াতও দিয়েছেন। প্রত্যেকটি বাড়িতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এবারের মেলায় লাখ দর্শনার্থী ও মধুপ্রেমীদের সমাগম ঘটবে। তিনি জানান, মেলাকে কেন্দ্র করে দেড় কোটি টাকা হাতবদল হয় বলে জানান তিনি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাগরদাঁড়ি পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে সাত বছর বয়সে কলকাতার খিদিরপুর স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজের অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি ভাষা শেখেন। ১৮৪৪ সালে তিনি বিশপস কলেজে ভর্তি হন। ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ওই কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখানে তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পান। এ সময় ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তার আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার পিতা এ সময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। তাই অগত্যা ১৮৪৮ সালে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজ গমন করেন তিনি। ১৮৪৮-৫২ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এ সময় সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। একই সঙ্গে হিব্রম্ন, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন। মাদ্রাজে অবস্থানকালে প্রথমে রেবেকা ও পরে হেনরিয়েটা'র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর ১৮৬২ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে বিলেত গমন করেন এবং গ্রেজ ইন এ যোগদান করেন। ১৮৬৩ সালে প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান। এরপর ১৮৬৫ সালে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৮৬৬ সালে গ্রেজ ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৮৬৭ সালে দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৮৭০ সালে হাইকোর্টে অনুবাদ বিভাগে যোগদান করেন। ১৮৭২ সালে কিছুদিন পঞ্চকোর্টের রাজা নীলমণি সিংহ দেও এর ম্যানেজার ছিলেন। এখানে কিছুদিন কাজ করার পর পুনরায় আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত সাহিত্য কর্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ১২টি গ্রন্থ এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পাঁচটি গ্রন্থ রয়েছে। ঞরসড়ঃযু চবহচড়বস ছন্দনামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ঞযব ঈধঢ়ঃরাব ষধফরব (১৮৪৮), দ্বিতীয় গ্রন্থ ারংংরড়হং ড়ভ ঞযব ঢ়ধংঃ। পদ্মাবতী নাটক, তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য, মেঘনাদ বধ মহাকাব্য, বীরাঙ্গনা (১৮৬২), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১), ব্রজাঞ্জনা (১৮৬১), হেক্টের বধ (১৮৭১), মায়াকানন (১৮৭৩), 'বঙ্গভাষা' 'কপোতাক্ষ নদ' ইত্যাদি সনেট। এই সনেটগুলো ১৮৬৬ সালে চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলি নামে প্রকাশিত হয়। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি তিনি ইংরেজি অনুবাদ করেন। ঊঁৎধংরড়হ (পরে বধংঃবৎহ এঁধৎফরধহ), গধফৎধং ঈরৎপঁষধঃড়ৎ ধহফ এবহবৎধষ ঈযৎড়হরপষব ও ঐরহফঁ ঈযৎড়হরপষব পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং গধফৎধং ংঢ়বপবঃধঃড়ৎ এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৮৪৮-১৮৫৬ সাল পর্যন্ত। ১৮৬২ সালে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে